তাহলে কি আবারো বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালু হচ্ছে !

শুরু থেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। ১৯৬২ সালের যে অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েট চলছে, তার ১৬ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, ছাত্র সংসদ, হল সংসদ ছাড়া ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের লিখিত অনুমোদন না নিয়ে কোনো ধরনের ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে না। এমনকি ক্যাম্পাসে সভা বা এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করার কথাও বলা আছে তাতে।

কিন্তু বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও তা অমান্য করেই বছরের পর বছর এই অঙ্গনে রাজনীতির কার্যক্রম চালিয়ে গেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। গত তিন দশকে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-দখলদারিত্ব  আর সেই সাথে বুয়েটের হলগুলোতে চলেছে র‍্যাগিং, নির্যাতন, হত্যাসহ নানা নৃশংসতা।ফলে ৯০ শতাংশ ছাত্রই ভয়ে দলগুলোর চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

বুয়েট ক্যাম্পাসে আইনানুগ সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই ক্লাব। এর সংখ্যা ২৯। এর বাইরে যত সংগঠনই থাকুক, তা বৈধ নয়। বিভিন্ন সময় যে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে যত সংগঠন ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তার একটিও ওই ২৯টি সংগঠনের মধ্যে যে নেই তা নিশ্চিত করেই বলা যাই ।

বুয়েটের মূল আইন হলো ১৯৬১ সালের দ্য ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স। এই আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছিল একটি বোর্ড। পুরো নাম ‘অর্ডিন্যান্স রিলেটিং টু দ্য বোর্ড অব রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন। অননুমোদিত ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব এই বোর্ডের। কিন্তু তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে । ১৯৮৯ সালের ৩১ জুলাই বুয়েটের একাডেমিক কাউন্সিল ওই অধ্যাদেশকে সর্বশেষ সংশোধন ও অনুমোদন দিয়েছিল বলে জানা যায়।

আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ছাত্র রাজনীতির প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য হলো, মতাদর্শগত অবস্থান। যে আদর্শের তারা চর্চা করবে। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে তাদের একটা ভূমিকা, অবস্থান ও আন্দোলন থাকবে ন্যায্যতা ও ন্যায়ের পক্ষে।

কিন্তু এদেশে ছাত্ররাজনীতির চরিত্র বদলেছে জাতীয় রাজনীতির হাত ধরে। গত কয়েক দশক ধরে যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন ফ্রাঙ্কেস্টাইনে পরিণত হয়েছে। যেখানে কোনো আদর্শের ব্যাপার নেই। কোনো ন্যায় আন্দোলনের ব্যাপার নেই।

ডাকসু’র ভিপি নুরুল হক নুর এক সংবাদ সম্মেলন ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন । তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৫১টি ছাত্র হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

এই প্রসঙ্গে ২০১৯ সালে বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অভিনেতা আবুল হায়াত,আবরার হত্যার বিক্ষোভে যোগদান দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বুয়েটে পড়েছি তখন এখানকার পরিবেশ এমন ছিলো না। আমাদের সময়েও রাজনীতি ছিলো না বুয়েটে। তাই বলে কি আমরা জাতীয় স্বার্থে যুক্ত ছিলাম না। ১৯৬৬ সালে, আমার মনে আছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিছিলটি হয়েছিলো বুয়েট থেকেই।

প্রসঙ্গ , ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বুয়েটের ছাত্র আববার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর চার বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। ঐ সময় বুয়েটের একটি আবাসিক হলের কক্ষে, শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, এ প্রেক্ষাপটে ছাত্র ছাত্রীদের ১০ দফা দাবির উত্তাল আন্দোলনের মুখে, বুয়েটে  ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এর আগে ২০০২ সালে ঘোষণা দিয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও তা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি। ২০০২ সালের জুনে ছাত্রদলের দুপক্ষের  গোলাগুলিতে বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনির মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী কিছুদিন ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ছিল।

পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগই প্রথম সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বুয়েটে ফের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। ২০১০-১১ সালেই দখলে নেয় পুরো ক্যাম্পাস ও হল।

প্রসঙ্গত গত বুধবার রাত দেড়টায় বুয়েটের মূল ফটক দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে সাদ্দাম হোসেনসহ ছাত্রলীগের অন্তত ৭০-৮০ জন নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। এ সময় বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে বৈঠক শেষে সেখানে খাওয়া-দাওয়া করেন নেতাকর্মীরা।

এর প্রতিবাদে ৫ দফা দাবি নিয়ে শুক্রবার ২৯ মার্চ থেকে উত্তাল বুয়েট ক্যাম্পাস । টানা দুদিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে এই আন্দোলনের বিপরীতে, বুয়েট কি পাকিস্তান যে ভিসা-পাসপোর্ট দিয়ে প্রবেশ করা লাগবে এমন বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন একজন মানুষের মৌলিক অধিকার ও সংবিধান বিরোধী-ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে নাটক বুয়েট ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছে সেটি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব শিক্ষার্থীর হলে থাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন।

বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আরো বলেন, পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। শুধু তাই নয়, এখানে আমার যাওয়াকে কেন্দ্র করে একটি নন-ইস্যুকে ইস্যুতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। আমরা বিভিন্নখানে যাই, আড্ডা দেই, সামাজিক সচেতনতামূলক সম্পর্ক থাকে। সেদিন আমি শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে ঝুম বৃষ্টির কারণে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়েছি। এটি একটি সাধারণ বিষয়। এটির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * তাহলে কি পুনরায় আবারো বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালু হচ্ছে !
লাইভ রেডিও
সর্বশেষ সংবাদ