আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও কমরেড ক্লারা জেটকিন
সাম্যের গান গাই –
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে – শয়তান যে – নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।
স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।
পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব।
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা।
লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।
তিনি নর-অবতার –
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর –
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!
ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!
-(“নারী’- কাজী নজরুল ইসলাম)
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ বাণীতে তাঁরা বিশ্বের সকল নারীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, নারী মুক্তি সংসদ, মহিলা পরিষদসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ উপলক্ষে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করবে। শোভাযাত্রাটি কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে এসে শেষ হবে।
এই নারী দিবসটি উদযাপনের পিছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। তাদের ওপরে দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ।
নানা ঘটনার পরে ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন করছে। তখন থেকেই বিভিন্ন দেশে নারীর সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে দিবসটি পালন শুরু হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাবক কমরেড ক্লারা জেটকিন শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ও পথিকৃত
জার্মান কমিউনিস্ট নেতা কমরেড ক্লারা জেটকিন শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ও পথিকৃত। এই মহীয়সীর নেতৃত্বেই সংগঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেছিলেন তিনিই। ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী।
শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের এক অসাধারণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কমরেড ক্লারা জেটকিন। ১৮৫৭ সালের ৫ জুলাই জার্মানির ছোট গ্রাম সাক্সসনায় তার জন্ম। পিতা গটফ্রেড আইজেনার ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও ধর্মপ্রাণ প্রোটেসস্ট্যান চার্চ সংগঠক ও দক্ষ বেহালা বাদক। মা জোসেকিন ভেইটালে আইজেনার একজন সুশিক্ষিত প্রগতিশীল নারী।
এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই ক্লারা জেটকিন বেড়ে উঠেন। একদিকে পিতার সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি মায়ের পুঁথি চর্চা তার মনোজগতে এক উন্নত ক্ষেত্র তৈরি করে। স্কুল কলেজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনি পাঠ করেছেন যে সকল বই তার মধ্যে রয়েছে বায়রন, ডিকেন্স, শেক্সপিয়ার, শিলার, গ্যাটে, হোমারসহ আরও অনেকে।
১৯১১ সালে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস সংগঠিত করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দলের কর্মী ছিলেন। পরে তিনি জার্মানির স্বাধীন সমাজ গণতান্ত্রিক দলে যোগদান করেন। সেই দলের দূর-বামপন্থী গ্রুপ স্পার্টাকাস লিগ থেকেই পরে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি (KPD) গঠিত হয়। তিনি সেই স্পার্টাকাস লিগের হয়ে ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত রাইখস্ট্যাগে প্রতিনিধিত্ব করেন।
শৈশবে জেটকিন শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলেও, অচিরেই তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। ১৮৭৪ সালের দিকে তার সাথে বিশেষ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জার্মানির নারী আন্দোলন এবং শ্রম-আন্দোলনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলোর।
নারীদের মাঝে ব্যাপকভাবে কাজ করার লক্ষ্যে ক্লারা ১৮৭৮ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দলে যোগ দেন। এই দলটি গড়ে ওঠার এক ইতিহাস আছে। ১৮৭৫ সালে দুটি দল একত্রিত হয়ে এই দলটি গড়ে উঠে। দল দুটি ছিল ফের্দিনান্দ লাসালে কর্তৃক গঠিত সাধারণ জার্মান শ্রমিক সংগঠন বা General German Workers’ Association বা সংক্ষেপে ADAV এবং আগস্ট বেবেল ও ভিলহেল্ম লাইবনেখত কর্তৃক গঠিত জার্মানির সমাজগণতান্ত্রিক শ্রমিক দল বা Social Democratic Workers’ Party of Germany বা সংক্ষেপে SDAP। পরে ১৮৯০ সালে এই দলটির আধুনিক সংস্করণ তৈরি হয়েছিল এবং নাম গ্রহণ করেছিল জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল বা Social Democratic Party of Germany বা সংক্ষেপে SPD।
১৮৭৮ সালে বিসমার্ক জার্মানিতে সমাজতন্ত্র-বিরোধী জরুরি আইন এবং সমাজতান্ত্রিক কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জেটকিন ১৮৮২ সালে জুরিখ চলে যান। পরে সেখান থেকে প্যারিসে নির্বাসনে যান। প্যারিসে থাকাকালীন তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮৭৪ সালের দিকে জার্মানির নারী আন্দোলন ও শ্রম আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভ্য হবার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং তার অন্যতম বন্ধু ওসিপ জেটকিনকে (১৮৫০ – ১৮৮৯) বিয়ে করেন। তাঁদের প্রথম সন্তান ১৮৮৩ সালে জন্ম নেয় ম্যাক্সিম জেটকিন। ২য় সন্তান ১৮৮৫ সালে কোনস্টাইনটিন জন্ম নেয়। পারিবারিক জীবনে অনেক অভাব-অভিযোগ রোগ-ব্যাধি সবকিছুই তিনি ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে মোকাবিলা করেন। একদিকে সংসার অন্যদিকে দেশ ও জাতির মুক্তি আন্দোলন। উভয় ক্ষেত্রেই তার দায়িত্ববোধ সমান্তরাল পর্যায়ে চালিয়ে গেছেন।
১৮৮৯ সালে দীর্ঘদিন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ওসিপ জেট জেটকিন মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯০ সালে পার্টির নতুন নাম হয় সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মান। স্বামীর মৃত্যুর শোক উপেক্ষা করে তিনি সেই পার্টির কাজে এগিয়ে আসেন।
এ সময়ে সহযোদ্ধা হিসেবে যাদের কাছে পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন- রোজা লুক্সেমবার্গ অন্যতম। ক্লারা ও রোজার মিলিত কর্মকাণ্ড নারী আন্দোলন ও শ্রমজীবী জনতার মুক্তি আন্দোলনকে আরও বেগবান, সুদূর প্রসারী ও সমগ্র দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এছাড়া প্যারিসে অবস্থানকালে আরও দুই মহান ব্যক্তিত্বকে কাছে পান। একজন মার্কস তনয়া লরা ও তার স্বামী পল গ্রাফার। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় তার পত্রিকা ‘ইকুয়েলিটি’ বা ‘সমতা’। ক্লারার সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্যারিসের নারী জাগরণের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখে।
যেই পত্রিকার মাধ্যমে শুধুমাত্র জার্মান নয়, সমগ্র বিশ্বের নারী সমাজ সমাজতন্ত্র বির্নিমাণের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং এক বৈপ্লবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কোনস্টাইনটেন সমতা পত্রিকা প্রকাশনায় মাকে সহযোগিতা করেন। ১৮৯১ হতে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকার সম্পাদকের পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১০ দালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলনে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করে প্রস্তাব রাখেন, প্রতি বছর ‘৮ মার্চ’ বিশ্বের সকল দেশের নারীসমাজ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন করবে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনো আন্দোলন করা যাবে না বলে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় তিনি তার প্রতিবাদ করেন। ১৯১৫ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের নিয়ে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেন।
১৯০৭ সালে দলের নারী বিষয়ক বিভাগ “Women’s Office” প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি এই বিভাগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেন শহরে। এই সভায় ১৭টি দেশের শতাধিক নারী-প্রতিনিধি যোগদান করেন। এই সম্মেলনে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দলের নারী-কার্যালয়ের (Women’s Office) নেত্রী হিসাবে তিনি যোগদান করেন এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস করার প্রস্তাব পেশ করেন। কংগ্রেস ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রতি বছর একই দিনে প্রত্যেকটি দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করতে হবে। একই সাথে তিনি ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে নিজে পালন করেন। এরপর থেকেই পৃথিবীব্যাপী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
১৯১৬ সালে স্পার্টাকাসপন্থী লিগের তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১৭ সালে জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল বা SPD ভেঙে Independent Social Democratic Party of Germany বা সংক্ষেপে USPD গঠিত হলে এটিরও তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি বা Communist Party of Germany বা সংক্ষেপে KPD প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রাইখস্ট্যগে ( Reichstag) এই দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২০ সালে তিনি লেনিনের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিলো – The Women’s Question। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সদস্য ছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য পদে ছিলেন। এসবের ভিতরেই ১৯২৫ সালে জার্মান বাম সংগঠন Rote Hilfe বা “লাল সাহায্য”-এর সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে প্রবীণ সদস্য হিসাবে রাইখস্ট্যাগের চেয়ার-ওম্যান পদে ছিলেন ক্লারা।
বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্য দিয়েও সমাজের ভেতর যে একটা সংস্কৃতিগত প্রগতিশীল রূপান্তর আনা যেতে পারে সে ব্যাপারেও ক্লারা জেটকিন বেশ সচেতন প্রয়াস নিয়েছিলেন। ১৮৯১ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘ইকুয়েলিটি’ বা ‘সমতা’ নামক নারীদের একটি পত্রিকা। ওই পত্রিকার মাধ্যমেই ক্লারা নারীদের সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করার পাশাপাশি তাদের ন্যায্য অধিকারের লড়াইগুলোর নানা বিশ্লেষণ ও সমাজে তার প্রভাবে সুফলগুলো প্রচার করতে থাকেন। এই পত্রিকা সমগ্র জার্মানসহ সারা বিশ্বের নারীদেরকে এক সমাজতান্ত্রিক সমতার পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে একত্রিত ও অনুপ্রাণিত করতে থাকলো। অধিকারের জন্য লড়াই করার প্রেরণা হয়ে উঠেছিল মুখপত্রটি। নারী ভোটাধিকারের লড়াইও তখন সমানতালেই চলছিল তার নেতৃত্বে।
এই সকল সংগ্রামী কাজের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে অনেক বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৯০৭ সালে আয়োজিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। এর পরবর্তীতে ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী নারী সম্মেলনে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এবং নারীমুক্তি ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ক্লারা জেটকিনই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। জেন্ডার বিভাজন তৈরির জন্য নয়, নারীদের যে সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সেটিকেই তুলে ধরে এবং প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সে লক্ষ্যে পৃথিবীর সকল মেহনতি মানুষের মুক্তির সাথে নারীরমুক্তিও যে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সেই বার্তা ও সংগ্রামকে ছড়িয়ে দিতে আজীবন লড়েছেন সুদৃঢ়ভাবে।
১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মান গঠিত হলে তিনি তার সাথে যুক্ত হন। ১৯২০ সালে তিনি কমরেড লেনিনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাজ প্রগতির সংগ্রামে নারীর ভূমিকা ও তার শ্রেণি সংগ্রাম এবং নারীমুক্তি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করেন। উত্তরও পেয়েছেন যথাযথ। ১৯৩২ সালে প্রবীণ সদস্য হিসেবে রাইখস্ট্যাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এডলফ হিটলার ক্ষমতায় এলে পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তিনি তখন ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। ১৯৩৩ সালের ২০ জুন তিনি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন। মস্কোর ক্রেমলিনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589