চট্টগ্রামে হোটেল রেস্তোরাঁ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি
চট্টগ্রামে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও হোটেল–রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভ্যাট আদায় বৃদ্ধি পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে।
তবে হোটেলসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে এই খাত দেশের রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা হতো। এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের সততার পাপাপাশি জনসচেতনতার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট নিলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। তা ব্যবসায়ীরা আত্মসাৎ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে। যেকোনো পণ্য বিক্রির সাথে সাথে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এটি দেশের প্রচলিত আইন। বিক্রয়মূল্যের ওপর নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট আদায় করা হয়।
এক্ষেত্রে সেবা, পণ্য ও উৎপাদনের ধরনের ওপর ভ্যাটের হারের শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। চট্টগ্রামে কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন ৮টি ভ্যাট বিভাগ রয়েছে। আগ্রাবাদ বিভাগ, চান্দগাঁও বিভাগ, চট্টলা বিভাগ, রাঙামাটি বিভাগ, পটিয়া বিভাগ, কঙবাজার বিভাগ, খাগড়াছড়ি বিভাগ ও বান্দরবান বিভাগের আওতাধীন পঞ্চাশ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে উক্ত বিভাগগুলো ভ্যাট আদায় করে।
চট্টগ্রামে গত অর্থবছরে ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। বছর শেষে ভ্যাট আদায় হয়েছিল ১৫ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছিল। আগের অর্থবছরে (২০২১–২২ অর্থবছর) চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে আদায় হয়েছিল ১০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এক অর্থবছরের ব্যবধানে ভ্যাট আদায় বেড়েছে ৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হলেও অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ লাখ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। নগরীর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোকে পুরোপুরি ভ্যাটের আওতায় আনা যায়নি। যাদের আনা সম্ভব হয়েছে তারাও নানাভাবে খদ্দেরদের কাছ থেকে বিল আদায় করেন। ভ্যাট হিসেবে মোট বিলের উপর ৫ শতাংশ অর্থ আদায় করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কোষাগারে জমা দেওয়া হয় না। ভ্যাট চালান চাইলে তালবাহানা করে।
নগরীর আগ্রাবাদের ভিলেজ রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে বিল পরিশোধ করতে গেলে হাতে লেখা বিল দেওয়া হয় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে। বিলে ভ্যাট হিসেবে ৫ শতাংশ অর্থ উল্লেখ করা হয়। ওই চিকিৎসক ভ্যাট চালান চাইলে রেস্তোরাঁয় কর্মচারীরা নানা বাহানা করে। শুধু ভিলেজ নয়, নগরীর বড় বড় রেস্টুরেন্টগুলো প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রদান করে না। এসব হোটেল–রেস্তোরাঁয় বিলের সাথে ভ্যাটের নামে অর্থ নেওয়া হলেও তা মালিকপক্ষ আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ আছে।
ভিলেজ রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা জানান, হাতে লেখা বিল দিয়েই তারা প্রতিদিন খাবার বিক্রি করছেন। একটি মেশিন আছে, তবে সেটি প্রায় সময় অচল থাকে। দিনের বেশিরভাগ সময় মেশিনটি বন্ধ থাকে বলে উল্লেখ করে এক কর্মচারী জানান, কাস্টমারদের কেউ ভ্যাট নিয়ে মাথা ঘামায় না। ভ্যাটের লোকজন এসে মাসিক ভিত্তিতে টাকা নিয়ে যায়।
চট্টগ্রামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টম এঙাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, প্রথমত আমরা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। এর ফলে আগে যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট পরিশোধ করত না সেগুলোকে এখন ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘদিন ভ্যাট বকেয়া পড়েছিল। আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে আটকে পড়া ভ্যাট আদায় করতে সক্ষম হয়েছি।
ভ্যাট পরিশোধে ব্যবসায়ীদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। আদালত থেকেও প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিও এক্ষেত্রে বড় প্রভাব রেখেছে। তেলের দাম বাড়ায় আমাদের রাজস্ব আয় বেড়েছে। সবকিছু মিলে আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৮.৭১ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয় করতে সক্ষম হয়েছি।
হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে পুরোপুরি ভ্যাট আদায় সম্ভব না হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা সবগুলো রেস্টুরেন্টে ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) স্থাপন করছি। তবে এসব মেশিন নিয়ে কিছু সমস্যা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণ সচেতন না হলে হোটেল-রেস্তোরাঁর ভ্যাট ফাঁকি ঠেকানো কঠিন। আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে থাকি। সর্বাত্মক চেষ্টা করি। কিন্তু হোটেল-রেস্তোরাঁকে পুরোপুরি ভ্যাটের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আমরা যে কার্যক্রম শুরু করেছি তা সফলভাবে সম্পন্ন হলে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
চট্টগ্রামে গত অর্থবছরে ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্জিত হলেও আগের বছরগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রামে ১৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
ভ্যাট কমিশনারেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছিল।
পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে ভ্যাট কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, জাতীয় উন্নয়নে ভ্যাটের গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণ, মিডিয়াসহ সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।