শিরোনাম
সিরাজগঞ্জে ভারতীয় সূতা উদ্ধার করেছে পুলিশ   » «    “প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারের ৫০% অন্তর্ভুক্তির পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ”   » «    ‘ক্রিসমাস ডে’ কে কেন বড়দিন বলা হয়?   » «    সাজাভোগ শেষে ভারত থেকে দেশে ফিরল ২৬ বাংলাদেশি পুরুষ ও নারী   » «    চাঁদপুরে জাহাজে খুনের ঘটনায় আটক ইরফান   » «   

১৪ হাজার কোটি টাকা আদায়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে: সৈয়দ আমিরুজ্জামান

শেখ জুয়েল রানা, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
আগামী ১৪ই জুন মাগুরছড়া দিবস। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও মহামূল্যবান আবিষ্কার মৌলভীবাজারের ১৪ ব্লকের অন্তর্ভুক্ত এই গ্যাসক্ষেত্রটিতে ব্লো-আউটের ২৬ বছর পূর্ণ হলেও অক্সিডেন্টাল-ইউনোকলের উত্তরসূরি শেভরনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়নি। এই ব্যাপারে জনমনে হাজারো প্রশ্নের নিরসনের জন্য ও খনিজ সম্পদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থেই ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে উপরোক্ত মন্তব্য করে, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি, ৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠন, ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা, সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, ১৯৯৭ সালের এইদিনে মাগুরছড়ায় দায়িত্বহীনতার কারণে যে ব্লো-আউট ঘটেছে এবং গ্যাস সম্পদ, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
এবার মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এতদিনেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি সরকার। সরকার আর প্রশাসন তো এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
বিদেশী একটি কোম্পানী আমাদের দেশের গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করলো, তাও তাদের অবহেলা-ত্রুটির কারণে, তাতে আমাদের সরকার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না। সম্পদ ধ্বংসের জবাবদিহিতা চাওয়া যাবে না- পাওয়া যাবে না। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা মেনে নেওয়া যায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর গত ২৬ বছরেও মেলেনি। ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমাদের একটাই কথা তা হলো, আমাদের দেশের তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদের এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুণ্ঠন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
মাগুরছড়া ব্লো-আউট, গ্যাস সম্পদ, তদন্ত রিপোর্ট ও আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া ১৪ নং গ্যাস ব্লকের অন্তর্গত একটি সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র। এটি দেশের খনিজ সম্পদের মানচিত্রে পূর্ণিমার চাঁদের মতো রৌশন ছড়িয়ে জনগণের স্বার্থে স্বাবলম্বী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারতো। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর বিনিয়োগের জন্য আগত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদারেরা ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাতে মাগুরছড়া ১নং অনুসন্ধান কূপে খনন চলাকালে বিস্ফোরণ ঘটায়।
মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরপরই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এক মাসের মধ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে দু’টি ভলিউমে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টটি জমা দেয়। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও বিতরণের বিষয়ে ৩ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে।
তদন্ত কমিটি সাব-কমিটিকে জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কমিটির তদন্তে অক্সিডেন্টালের কাজে ১৫/১৬টি ত্রুটি ধরা পড়ে। অক্সিডেন্টালের কর্মকর্তা ২/৩টি ত্রুটির ব্যাপারে আপত্তি জানালেও বাকিগুলো স্বীকার করে নিয়ে তদন্ত রিপোর্টে স্বাক্ষর করে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনার কারণেই ঘটে যাওয়া এ বিস্ফোরণে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, মৌলভীবাজার স্ট্রাক্চার, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানি সম্পদ, রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তদন্ত রিপোর্টে মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূ-গর্ভস্থ গ্যাসের পরিমাণ ৪৮৫.৮৬ বিসিএফ এবং এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৪৫.৮৬ বিসিএফ উল্লেখ করা হলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতি ১০০০ সিএফ গ্যাস ২.৬ মার্কিন ডলার হিসাবে বাংলাদেশী টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাসের দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩৮৩৪.৪৮ কোটি টাকা।
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ছোট বড় ৩৯টি চা বাগানের ক্ষতির পরিমাণ ৪৬ কোটি ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকা। বনাঞ্চলের ৬৯.৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণ বয়স্ক গাছ আগুনে পুড়ে গেছে বলে হিসাব করা হয়, যার ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয় প্রায় ৩৩.৬১ কোটি টাকা। একটি বনের স্বাভাবিক উচ্চতার গাছ বাড়তে প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ বছর। এ বনের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ১১০ বছর সময় লাগবে। প্রতি বছর ৮০.৩০ কোটি টাকা হিসাবে ১১০ বছরে বনাঞ্চলের পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয় ৮,৮৩৯ কোটি টাকা। বনাঞ্চলের আংশিক ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৮,১০০ গাছ এবং ২২.৫০ হেক্টর ভূমি; উক্ত ক্ষতি থেকে উদ্ধার পেতে সময় লাগবে ২০ বছর; উক্ত ক্ষতি বাবদ ধরা হয়েছে ৫০৭.১২ কোটি টাকা।
এছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ধরা হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫,৪৫০ গাছ; উক্ত ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পেতে সময় লাগবে ১০ বছর এবং ক্ষতি বাবদ ধরা হয়েছে ৪৮৪.৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯,৮৫৮ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফিট রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস হয়েছে, এতে ক্ষতি দেখানো হয়েছে ৮১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা (রাজস্ব ব্যতীত)।
সড়ক পথ (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপ লাইন (রাজস্ব) বাবদ ক্ষতি ১৩ লক্ষ টাকা। বিদ্যুৎ লাইন (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ৯১৮৬ টাকা। খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজ সমূহ (রাজস্ব ব্যতীত) বাবদ ক্ষতি ধরা হয়েছে ১৮ লক্ষ টাকা। বাস মালিকদের রাজস্ব ক্ষতি ধরা হয়েছে প্রতিদিন ৪৭,৭৫০ টাকা হারে মোট ১২ লক্ষ টাকা। (তথ্যসূত্র: তদন্ত রিপোর্ট, ৩০শে জুলাই, ১৯৯৭ইং)
তদন্ত রিপোর্টের ৮.৪.৬ ও ৮.৬ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ দে’য়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিরূপণের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মাগুরছড়ার মোট ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ এলাকায় দুর্ঘটনার সময় ৬ জন শ্রমিক, ৫ জন সিকিউরিটি ও ১ জন রিগম্যান কর্মরত ছিলেন। রাত প্রায় একটার দিকে গ্যাসকূপে প্রথম মৃদু ভূকম্পন, তারপর বিদঘুটে আওয়াজ শুরু হলে রিগম্যান দ্রুত রিগ থেকে নেমে পড়েন। কূপ খননের জন্যে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানী অক্সিডেন্টাল যে উপ-ঠিকাদার নিয়োগ করে গ্যাসকূপ খননে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল আনকোরা। খননকাজে জার্মান ডয়টেগ-এর অভিজ্ঞ লোকবলের যেমন অভাব ছিল তেমনি পূর্ব কোন সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিলো না। ছিলনা কার্যোপযোগী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। কূপ খনন কাজে ডয়টেগের যন্ত্রপাতি ছিল পুরানো ও ত্রুটিযুক্ত। এর মান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ছিল না। দায়িত্বরত রিগম্যানও ছিল সহকারী পর্যায়ের।
উৎপাদন বণ্টন চুক্তির শর্তানুসারে কূপ খননের প্রকল্প এলাকায় অক্সিডেন্টাল থেকে একজন, পেট্রোবাংলা থেকে একজন খননবিদ সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থাকার কথা। অক্সিডেন্টাল চুক্তির এ শর্তকে তেমন কোনো গুরুত্ব প্রদান করেনি। বিস্ফোরণকালে কূপ এলাকায় কোনো খননবিদ উপস্থিত ছিলেন না।
দুর্ঘটনা এড়ানো ও খনন কাজ সহজ করার উদ্দেশ্যে কূপ খননের সময় যে কেসিং প্রতিরক্ষা বহিরাবরণ তৈরি করা হয় তার নকশায় ছিল মারাত্মক ধরনের ত্রুটি। অক্সিডেন্টাল ও ডয়টেগের আনাড়ি প্রযুক্তিবিদরা এ নকশা তৈরি করে। অক্সিডেন্টালের খনন কাজে আনাড়িপনা, অনভিজ্ঞতা, দায়িত্বে অবহেলা, উদাসিনতা, ত্রুটি, অযোগ্যতা দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তোলে। দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের অযোগ্যতা ও খনন কাজের নিম্নমান হওয়ার প্রধান কারণ হলো টাকা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সস্তায় লোকবল নিয়োগ করা। উন্নয়ন অংশীদার আমেরিকার কোম্পানি অক্সিডেন্টাল এদেশের গ্যাসক্ষেত্র লুণ্ঠনে অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে বিনিয়োগ তত্ত্ব প্রয়োগ করেছে বৈকি।
এ তত্ত্বকে কার্যকর করার জন্যে অক্সিডেন্টাল কোম্পানী সব সময় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পেট্রোবাংলার কাছে তথ্য গোপন রাখে। চুক্তির শর্তানুসারে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে তাদের গৃহীত যাবতীয় কর্মসূচি, পদক্ষেপ ও অত্যাবশ্যকীয় টেকনিক্যাল বিষয়ে জানাতে হলে অক্সিডেন্টাল তা পেট্রোবাংলাকে জানায় একেবারে শেষ মুহূর্তে অথবা কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর। নির্দিষ্ট তথ্যটি অবগত হওয়া ছাড়া পেট্রোবাংলার তখন আর কিছুই করার থাকে না। গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে অক্সিডেন্টালের তথ্য গোপন করার অভিযোগে অক্সিডেন্টালকে ইতিপূর্বে নাইজেরিয়া থেকে পাততাড়ি গুটাতে হয়েছে। লিবিয়া থেকেও তাড়া খেয়ে ফিরে যায়। তাদের অপকর্মে নাইজেরিয়ার গ্যাস-তেল সম্পদ নিঃশেষীকরণ, পরিবেশ ও উর্বর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।
মানুষ রোগে ভূগছে। পরিবেশ বিষাক্ত আকার ধারণ করেছে। অনুসন্ধান কূপ খনন করার সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়। এ কাজে সাধারণত ডিনামাইট জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অক্সিডেন্টাল চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে মাগুরছড়ার গ্যাস কূপ খনন কাজে বিস্ফোরক হিসেবে প্রাণঘাতী ও পরিবেশ বিনাশী তেজস্ক্রিয়যুক্ত ‘রেডিও একটিভ সোর্স’ ব্যবহার করে। পেট্রোবাংলা এ সংবাদ জানতে পারে গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের কয়েক মাস পর। পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য খনন কাজ স্বল্পতম সময়ে সম্পন্নকরণ। যত কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা যায় তত বেশী মুনাফা লাভ করা যায়।
জনগণের স্বাস্থ্য, জীবন ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকার কোম্পানী অক্সিডেন্টালের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসেনি। বহুজাতিক পুঁজির আগমন ঘটেছে বহুজাতিক তান্ডব ও লুণ্ঠনের আদর্শ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে নয়। মাগুরছড়া ব্লো-আউট, বিশেষজ্ঞদের প্রথম দিকের প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল গ্যাস জোনের আয়তন ছিল দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার এলাকা। এ কূপে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটেরও অধিক গ্যাস মজুদ ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ছিল ৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৮ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। টাকার বারবার অবমূল্যায়নের কারণে এ মূল্য বর্তমানে আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ এ সংরক্ষিত প্রাচীন অরণ্য ভূমির পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার অর্থনৈতিক মূল্যও হবে সমপরিমাণ। যদি প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তা হলেও ১৯৯৭ সালের ১৪ জুনের পূর্বেকার পরিবেশগত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে লাগবে একশত বছরের অধিক কাল।
গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে ব্যয় দেখিয়ে অক্সিডেন্টাল ৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের একটি হিসেব পেট্রোবাংলায় দাখিল করে। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দাঁড়ায়। গ্যাসকূপ খনন কাজে নিয়োজিত রয়েছে পেট্রোবাংলার অঙ্গ সংস্থা বাপেক্স। এ সংস্থার কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি যুক্ত পেট মোটা করে হজম সম্পন্ন করার পরও সার্থকভাবে একটি কূপ খননে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ৭৫ কোটি টাকা।
২৬ বছর পূর্ণ হলেও অক্সিডেন্টাল বা অক্সির উত্তরসুরী ইউনোকল পরবর্তীতে শেভরনের কাছ থেকে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ এলাকা পরিত্যাগকালে অক্সিডেন্টাল প্রচারণার সর্বোচ্চ মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে। আড়াইশত বছরেরও অধিককাল ধরে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ ও বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজির অধীনে শেকল টানা এ বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীর মুখে লেপন করে দেয়া হয় লুটেরা ও সন্ত্রাসীর কালিমা।
অক্সিডেন্টালের প্রচারণা বাস্তবতার সাথে যে সংগতিপূর্ণ নয় এ সত্যটি জনগণের কাছে অনেক আগেই পরিস্কার হয়ে যায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ লক্ষণ দেখে বাস্তবতা উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বা বিচারকের রায়ের ওপর নির্ভর না করেই ঘটনা জাত সম্পর্ক, পরিবেশ ও লক্ষণসমূহ বিশ্লেষণ করে সঠিক অনুমানে পৌঁছে যেতে পারে মানুষ। অক্সিডেন্টালের প্রচারণা সত্ত্বেও শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ এলাকার জনগণসহ বৃহত্তর সিলেটবাসী অক্সিডেন্টালের বিরুদ্ধে আক্রোশে-আন্দোলনে মাগুরছড়া গ্যাস কূপের আগুনের মত জ্বলে উঠতে থাকে।
ছয় মাসেরও অধিককাল ধরে আগুনের গ্যাস উদগীরনকারী গ্যাস কূপের উৎস মুখ সিল করার কাজ সম্পন্ন হয় ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮। তারও আগে ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ থেকে অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে রাতের আঁধারে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র আস্তে আস্তে সরাতে আরম্ভ করে। চোরের মতো অবস্থান পরিবর্তন করতে দেখে জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে কমলগঞ্জের রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বামগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ন্যাপ, জাসদ, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সিপিবি-এর উদ্যোগে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সমগ্র সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু জনগণের আন্দোলনেও জনগণের সম্পদ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়নি।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
বিষয়: * কোটি টাকা * গ্যাসক্ষেত্র * মাগুরছড়া দিবস * মৌলভীবাজার
সাম্প্রতিক সংবাদ