নজরুল কাব্যে প্রেমঃ নারী ও নিসর্গ

মোহাম্মদ শাহ আলম, মুরাদনগর, কুমিল্লা :

নজরুল সাহিত্যের অন্যসব শাখা থেকে তার কাব্য ও সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য একটু আলাদা। কবিতা আর গানে নারী ও নিসর্গের মাঝে প্রেম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। নারী ও নিসর্গের প্রেম ভালোবাসায় অভিসিক্ত কবি নজরুলের প্রেমপিয়াসী আর সুন্দরের এই পুরুষোত্তম কবি। প্রেমের তাজমহল গড়েছেন কবি তার অমর কাব্যে। কবিতার শরীরে আছে প্রেমোচ্ছ্বাস। নজরুল কাব্যে প্রেমের আলোকচ্ছটা দেখা যায় দশদিগন্তে
বিচ্ছুরিত।
নজরুল সকল সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা, নীচতা আর হীনতার ঊর্ধ্বে উঠে মানব প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি সকল অন্যায় অত্যাচারের
বিরুদ্ধে  লিখে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী। দ্রোহের আড়ালে জ্বলে লুকায়িত কবির প্রেমের দীপশিখা। কবি মাত্রই প্রেমিক, প্রেম বিলাসী। প্রেমের স্নিগ্ধ পরশে জন্মে কাব্যের নতুন আবাহন।
অসত্য আর অন্যায়ের বেড়াজাল ডিঙিয়ে কবি সত্য আর সুন্দরের ফুল ফোটান। ফুলের  সৌরভে বিমোহিত হয় কবিপ্রাণ। কবি নজরুলের বিদ্রোহী সত্তায় প্রেমের উষ্ণপ্রস্রবনের ঢেউ লেগেছে। মোহনীয় সেই রূপসুধা আকন্ঠ পান করেন কবি। প্রেম চিরন্তন, শাশ্বত আর পবিত্র। নজরুল তার গান আর কবিতায় প্রেমের এই শাশ্বতরূপকে ধারণ করেছেন। কিট্স, শেলী আর ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের মতো নজরুলও নিসর্গবাদী প্রেমিক কবি।
প্রকৃতির সাথে মানবজীবনের সম্পর্ক অতিশয় নিবিড় ও মধুর। প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়ে প্রকৃতির অফুরান দানে বেঁচে থাকে। প্রকৃতির কমনীয় রূপ ধরা দেয়  কাব্য ও সঙ্গীতে।
নজরুলের মনে প্রেমের সুপ্ত চেতনা জেগে উঠে। আর তা কাব্যলক্ষ্মী হয়ে ধরা দেয় তার কাব্যে। প্রকৃতি ও প্রতিবেশ নারীর সম্মিলন ঘটে। তার বিদ্রোহী সত্তায় জেগে উঠে প্রেমানুভূতি। পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ ও শত অন্যায় অত্যাচারে কবি হৃদয় ছিলো সংক্ষুব্ধ। যন্ত্রণাকাতর স্বাধীনতাকামী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় প্রেমের শীতল পরশ পাওয়া যায়।
‘আমি অভিমানী চিরক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কন্ -কন্।’
(বিদ্রোহীঃ অগ্নিবীণা)

নজরুলের কাব্যে প্রেমের অমিয়ধারা উপচে পড়ে। প্রেমের প্রাপ্তিতে সুখ আছে, আছে আনন্দ। কিন্তু ব্যর্থতায় বাড়ে দুঃখ, জ্বালা-যন্ত্রণা। অতৃপ্তি আর বিরহ বেদনার নৈরাশ্যে জীবন হয় বিষাদময়। তেমনি কবিপ্রিয়া নার্গিসের জন্য কবিহৃদয় বিদীর্ণ। বেদনাতুর হৃদয়ের হারানো সুর বাজে তার অন্তরে। তার প্রেমের কবিতা ও সঙ্গীতে তা স্পষ্টতই  প্রকাশ।
নারী ও নৈসর্গিক প্রেমের চিরন্তন রূপ
নজরুলের কাব্যে।পথিক কবির অন্তরে বহে প্রেমের এমনি স্বচ্ছধারা যা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। মন্থন করে কাব্য সুধা। তিনি লেখেন-
‘তুমি আমায় ভালোবাসো তাইতো আমি কবি আমার এ রূপ সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।’
(কবিরাণীঃ দোলনচাঁপা)
বৈষ্ণব সাহিত্যে আছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। বিহারীলাল রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে রোমান্টিকতা। নজরুলের কবিতাও এর বাইরে নয়।
তার কবিতা ও সঙ্গীতে রোমান্টিকতা দেখিয়েছেন অতিমাত্রায়। সচেতন মন নিয়ে প্রেমের বিচার করেননি। হৃদয়াবেগের তীব্রতাই ছিলো । তত্ত্ব নয়, প্রেমের আবেগই তাকে আলোড়িত করেছে বেশি।
‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেলো কবিপ্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান’।

(নারীঃ সর্বহারা)
প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণ মানুষের সৃষ্টিলগ্ন থেকে। মানব-মনবীর গভীর সত্তায় এর বসবাস। এর বন্ধন দুশ্ছেদ্য। কবি নজরুল নিসর্গের মাঝে রূপের বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত। তিনি প্রিয়াকে সাজাতে চেয়েছেন মাটির’ ‘তারার ফুলে’, ‘ঝিঙেফুলে’র হলদে রঙে,বাঁকা ‘চাঁদের দুলে’ এবং ‘রামধনুর রং আলতায়’।
কবির কাছে নারী ‘প্রেম-মাধবীর’এক অপরূপ সৌন্দর্য। ‘প্রিয়ার রূপ’ কবিতায় তিনি লেখেন-
‘অধর নিসপিস্
নধর কিসমিস্
রাতুল তুলতুল
নাসায় তিলফুল
হাসায় বিলকুল’।

(প্রিয়াররূপঃ ছায়ানট)
মধ্যযুগীয় কবিরা নারীর বাহ্যিক রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। নজরুলের কাব্যে তা ব্যতিক্রম। তিনি নারীর অন্তঃজীবনের সত্তাকে তুলে ধরেছেন।চিরচাওয়া প্রেমের পরিণতি হয় চিরবিরহে। না পাওয়ার বেদনার ঢেউ লাগে কবির হৃদয়তটে।
‘দূরের প্রিয়া। পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন রোল,
কূল মেলে না, তাই দরিয়ার
উঠতেছে ঢেউ দোল’।

( গোপন-প্রিয়াঃ সিন্ধুহিন্দোল)

নজরুলের কাব্যে নারীর কল্যাণরূপী রূপ মমতাময়ী মাতা, স্নেহময়ি ভগ্নি কিংবা প্রিয়তমা প্রেয়সীকে দেখা যায়।
নারী জাগরণের ‘সম্মোহনী বাণী ধ্বনিত হয় তার সঙ্গীতে- ‘ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।’
কবিতায় লেখেন-
‘কোনোকালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়ী লক্ষ্মী নারী।’

(নারীঃ সাম্যবাদী)
মহান সৃষ্টির মূলে কবি নারীকে দেখিয়েছেন প্রেরণারূপে। শ্বেতপাথরের  তাজমহল সম্রাট শাহজাজাহানের সৃষ্টি হলেও এর মূলে
মহীয়সী মমতাজের প্রতি সুনির্মল ভালোবাসার পুণ্যস্মৃতি। কবি লেখেন-
”তাজমহলের পাথর দেখেছ,দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।’

(নারীঃ সাম্যবাদী)
নজরুল নারীর স্বীয় মর্যাদা ঘোষণা করেছেন উচ্চকন্ঠে।

‘বিশ্বে যা- কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

(নারীঃ সাম্যবাদী)
তিনি দেখিয়েছেন নারীদের ত্যাগ আর
ধৈর্যের মহিমা।
‘জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্।’

(নারীঃ সাম্যবাদী)
নজরুলের ‘দোলনচাঁপা’,’ছায়ানট’,’পূবের হাওয়া’,
‘চক্রবাক,’ ‘সিন্ধুহিন্দোল ‘ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে প্রেমের চিরন্তন শিখা প্রজ্জ্বলিত। যৌবনের স্বভাবসুলতায় কবি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছিলেন প্রাণচঞ্চল। তার হৃদয় সরোবরে প্রেমের প্রস্ফুটিত শতদল ভরে আছে। নজলুল কাব্যে প্রেম ও মানবতার বন্দনা আছে। আছে নিসর্গের মাঝে নারীর রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা।
‘খোপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে,ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি” বউগো কথা কউ”।
ডাকত ডাহুক জল-পায়রা
নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুরু ওড়া যেন আসমানে
গাঙ্ চিল”।

(চৈতী হাওয়াঃছায়ানট)

‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে দৌলতপুরের নার্গিসের সাথে প্রেমবিরহ ও বেদনার সুর আছে।
“নিখিল কন্ঠে দুলবে তুমি গানের কন্ঠহার-
কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার!
যেদিন আমি থাকব না ক’ থাকবে আমার গান,
বলবে সবাই,’ কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?”

(এ মোর অহঙ্কারঃ চক্রবাক)

এরপরও কবি তার প্রথম প্রণয়ের প্রিয়া নার্গিস স্মরণে  লেখেন-
“তুমি আমার বকুলযূথী- মাটির তারাফুল,
ঈদের প্রথম চাঁদ গো তোমার কানের পার্সি ফুল।
কুস্ মী- রাঙা শাড়িখানি
চৈতী-সাঁঝে প’রবে রাণী,
আকাশ গাঙে জাগ্ বে জোয়ার
রঙের রাঙা বান,
তোরণ-দ্বারে বাজবে করুণ
বারোয়াঁ মূলতান।”

(এ মোর অহঙ্কারঃ চক্রবাক)
‘দোলনচাঁপা’ বর্ষা প্রকৃতির একটি
সুন্দর পুষ্প উপহার। নজরুলেরর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী দুলী বা দোলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। নজরুল তার প্রেমের সারথীদের মাঝে নৈসর্গিক উপমা টেনেছেন সুন্দরভাবে, চিত্রিত করেছেন প্রেমের মোহনীয় রূপ বিচিত্র অনুভূতিতে। নজরুলের কবিতায়  নৈসর্গিক উপমার প্রয়োগ ছিল যথার্থ। নৈসর্গিক উপমা আর চিত্রকল্প ছাড়া কবিতা হয় নিষ্প্রাণ। নিসর্গের ভেতর কল্পনা করেছেন কবি তার প্রিয়ার রূপকে। কবির তার তীব্র সংরাগ সঞ্চালিত নিসর্গের শিরা উপশিরায়। কবিচিত্ত দোলা দেয় ‘ছায়ানটে’র চৈতী হাওয়ায়’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’র ‘বাসন্তী ও মাধবী প্রলাপে’। যুঁই, চামেলী, কেতকী, চম্পা,বকুল হাসনা হেনা, বেলী, টগর, বেল, গোলাপ, ইরানী নার্গিস ফুলের বর্ণনা আছে নজরুলের বিভিন্ন গান ও কবিতায়।দোলন চাঁপা, ঝিঙেফুল ‘ নামক কাব্যগ্রন্থ  ফুলের নামে  নামকরণ  করেছেন  কবি।
সর্বোপরি নজরুল প্রেমের কবি। প্রেমের চিরন্তন রূপ যা নারী নিসর্গের মাঝে বিদ্যমান। প্রেম আর প্রকৃতির মাঝে নারীর অনুষঙ্গ কবি মানসকে করেছে আরো উজ্জীবিত।কবির অশান্ত মনকে প্রশান্তির সুমিষ্ট ছোঁয়া এনে দিয়েছে নারী ও নৈসর্গিক প্রেমের অনুপম শীতলধারা।

লেখকঃ মোহাম্মদ শাহ আলম
( শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি)
বাংলা বিভাগ
অধ্যাপক আবদুল মজিদ কলেজ
মুরাদনগর, কুমিল্লা

সহায়ক গ্রন্থাবলিঃ
১।নজরুল ইসলামঃ নানা প্রসঙ্গ – মুস্তাফা নূরুল ইসলাম সম্পাদিত
২।নজরুল কাব্য সমীক্ষা-আতাউর রহমান
৩।নজরুল ইসলাম- দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
৪।নজরুল সাহিত্য বিচার-শাহাবুদ্দিন আহমদ।
৫।নজরুলচেতনা-
মোহাম্মদমনিরুজ্জামান
৬। নারী জাগরণ ও নজরুল সাহিত্যে নারী- শাহনাজ মুন্নী

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * নজরুল কাব্যে প্রেমঃ * নারী ও নিসর্গ