শ্রীমঙ্গলের নিরালা পুঞ্জি, পরিচ্ছন্ন এক খাসিয়া পল্লী ভ্রমণ
সুজন কুমার দেবনাথ, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
উচু-নীচু পাহাড়ী রাস্তা। কখনো দু’পাশে চা বাগান, কখনো একপাশে পাহাড়, একপাশে খাদ আবার কখনো দুপাশেই চেপে এসেছে পাহাড়, মাঝখানে এক চিলতে রাস্তা। সেই রাস্তাও কোথাও ইট বাঁধানো, কোথাও সিমেন্টের ঢালাই। তবে রাস্তা কিন্তু বিপদজনক। কারণ হরিণচড়া বাজার হতে শুরু চড়াই-উৎরাই। এ রাস্তায় একমাত্র বিশ্বস্ত বাহন ফোর হুইল জীপগাড়ী আর ভাড়ায় চলা মোটর বাইক।
বলছিলাম মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত খাসিয়াপল্লী নিরালা পুঞ্জির কথা। বেশ কিছুদিন ধরেই ইউটিউবে দেখছিলাম নিরালাপুঞ্জীর ভিডিও। অনেকদিন ভ্রমণে যাওয়া হয় না। তাই কিছুটা পরিকল্পনা করে কিছুটা এবং কিছুটা হুটহাট সিদ্ধান্তের বশেই গত ২১ অক্টোবর শুক্রবার ভোর বেলা রওনা হই শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
আমার ভ্রমণের চির সঙ্গী বন্ধু সিকান্দারকে নিয়ে মোটরসাইকেলে রওনা দেই সকাল সাড়ে পাঁচটায়। শ্রীমঙ্গল শহর হতে ফিনলে চা বাগানের ভিতর দিয়ে প্রথমে হরিণছড়া বাজারে যাই। সেখানে হালকা নাস্তা করি। তারপর গুগল ম্যাপ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে পথের হদিস জেনে নিয়ে রওনা দেই নিরালাপুঞ্জী খাসিয়া পল্লীতে যাওয়ার জন্য। সমতল পাকা রাস্তা শেষ হওয়ার পর শুরু হল চড়াই-উৎরাই। দক্ষ গাড়ী চালক আর ভাল মোটর বাইক না হলে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রী খাড়া পাহাড়ী রাস্তায় বাইক রাইড করা রীতিমত অসম্ভব। এর পাশাপাশি চরম সাহস না থাকলে কেউ এই রাস্তায় বাইক চালাতে পারবে না। যাহোক আমরা ভালভাবেই নিরালা পুঞ্জীতে পৌছি প্রায় এগারটার সময়। খাসিয়া পাড়ায় পৌছে আমরা আরও কিছু পর্যটকের সাক্ষাৎ পাই। নিরালাপুঞ্জী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আমাদের বাইক রেখে পুরো পাড়া ঘুরে ফিরে দেখি। পাড়ার কোথাও কোন ময়লা নেই। পরিচ্ছন্ন এক গ্রাম। এই নিরালা পুঞ্জীকে অনেকে পানপুঞ্জী বলেও ডাকে। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পান চাষের সাথে জড়িত। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় এখানে পান চাষ হয় সুপারী গাছসহ অন্যান্য গাছে। বাড়ীর পুরুষেরা গাছ থেকে পান সংগ্রহ করে চট (বেত দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের ঝুড়ি) ভর্তি করে বাড়িতে পৌছায়। প্রত্যেক বাড়ীতে পান বাছাই করার জন্য আলাদা করে মেঝে পাকা করে বাধানো ছোট একটি ছাউনি আছে। সেই পান প্রথমে পানি দিয়ে ধুলোবালি পরিস্কার করে গোছানো হয়। পান গোছানোর কাজটি করে পাড়ার মহিলারা। সেই পান পরবর্তীতে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা শহরে এনে বিক্রয় করা হয়। পুরো পাড়ায় দুটি খ্রিস্টান চার্চ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তিন- চারটি মুদি দোকান আছে। পাড়ায় রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ আর ডিশ লাইনেরও সুব্যবস্থা। পাড়ার সকলেই খুব আন্তরিক। ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলে পরিকল্পনা করে চলে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গলের এই পরিচ্ছন্ন পাড়ায়। সারাদিন ঘুরে প্রশান্ত এক মন নিয়ে ফিরবেন নিজ শহরে। তারপর শুরু হয়ে যাবে আবারও সেই কর্ম মুখর ব্যাস্ত জীবন।
কিভাবে আসবেন :
বাংলাদেশের যে কোন জেলা থেকে যাতায়াতের জন্য বাস পাবেন। তবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে আসলে। রাতের বাসে বা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল এসে পৌছতে ভোর হয়ে যাবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্টের সামনে হতে বা শ্রীমঙ্গল বাজার কালীঘাট রোড হতে বাইক বা ফোর হুইল জীপ গাড়ি ভাড়ায় পেয়ে যাবেন। ভাড়ার বিষয়টি অবশ্যই দরদাম করে নিবেন। এই পাড়ায় ঘুরতে কোন গাইড লাগবে না। আপনার ভাড়া নেওয়া গাড়ীর চালকই আপনাকে পুরো পাড়া ঘুরিয়ে দেখাবে।
খাবার-দাবার :
নিরালা পুঞ্জীতে খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই। দু-তিনটি মুদী দোকান আছে। সেখানে হালকা খাবার সহ কোল্ড ডিংক্স পাবেন। তবে সকাল সকাল পাড়ায় গিয়ে দুপুর তিনটার মধ্যে শ্রীমঙ্গল শহরে ফিরে আসতে পারলে দুপুরের খাবার শ্রীমঙ্গল শহরেই করতে পারবেন। তাছাড়া ভিন্ন কিছুর স্বাদ নিতে আদি নীলকণ্ঠ চা কেবিন হতে সাত রং এর চায়ের স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
দর্শনীয় স্থান :
শ্রীমঙ্গল শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দক্ষিণে গেলেই ফিনলে চাবাগান এলাকা শুরু। সেই চা বাগান ও উচু নীচু টিলা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার যেতে হবে হরিণছড়া বাজার পর্যন্ত। তারপরেই পাহাড়ী বিপদ জনক পথের শুরু। চাবাগান, পাহাড়, পরিচ্ছন্ন খাসিয়া পল্লী দেখে ফেরার পথে সাতগাঁও চা বাগান এলাকায় চা কন্যার সাদা ভাস্কর্য্য, আলিয়াছড়া গুলবাহার খাসিয়া পল্লী, পাহাড়ের উপর ৭১ এর বধ্য ভূমি, শ্রীমঙ্গল রোডের দুই পাশের রাবার বাগান ঘুরে দেখতে পারেন। আসলে শ্রীমঙ্গল দেখা শেষ হবে কিনা সন্দেহ আছে। প্রকৃতি তার আপন হাতে চা বাগান আর পাহাড় দিয়ে সাজিয়েছে শ্রীমঙ্গলকে। আপনিও চাইলে পরিবার নিয়ে অবসরে ঘুরে আসতে পারেন। অবারিত প্রকৃতি চির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে ভ্রমণপিপাসুদের অপেক্ষায়….