বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু : শোকে স্তব্ধ মাটিকোড়া গ্রাম
শুভ কুমার ঘোষ, সিরাজগঞ্জ:
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের মাটিকোড়া গ্রামে মাঠে কাজ করা অবস্থায় বজ্রপাতের ঘটনায় আপন দুই ভাই ও চার পিতা-পুত্রসহ একই পরিবারের ৫ জনসহ ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গ্রামটি। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে স্বজনরা।
চোখের সামনে এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসী। কেউ হারিয়েছেন সন্তান কেওবা স্বামী। আবার কেউ হারিয়েছেন বাবা, বাবার সঙ্গে নিজের বান্ধবীকেও। সান্ত্বনার বাণীও যেন স্তব্ধতা ও নিরবতায় পরিণত হয়েছে এলাকাবাসীর।
শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিনে ঘটনাস্থল মাটিকোড়া গ্রামে গেলে দেখা যায় এমনই দৃশ্য। মাটিকোড়া গ্রামেরই নিহত হয়েছেন শিশু ও কিশোরীসহ ৪ জন। আহত হয়ে হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আরো ৪ শিশু।
মাটিকোড়া গ্রামের নিহতরা হলেন, নুরুল ইসলামের পুত্র শাহ আলম (৪০), বাহাদুর আলীর পুত্র আব্দুল কুদ্দুস (৬০), আলিম মিয়ার মেয়ে রত্না খাতুন রিতু (১২) ও মোস্তফার মেয়ে মারিয়া (৭)। এছাড়াও আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে নূরনবীর মেয়ে নূর জাহান (৯) ও তার বোন নূর নাহার নদী (১২), সাইফুল প্রামানিকের মেয়ে রুপা (১২) ও রফিকুল ইসলামের মেয়ে আমিনা (১৩)। এর মধ্যে নূর নাহার নদী গুরুতর অবস্থায় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে।
নিহত রিতুর বাবা আব্দুল আলিম বলেন, আমার মেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির পাশেই একটি ডোবাতে গোসল করতে যায়। কিন্তু ডোবায় কচুরিপানা থাকায় পাশেই দেখতে পায় শ্যালো ইঞ্জিন চালিয়ে জমিতে পানি দেয়া হচ্ছে। তখন সেখানে সে গোসল করতে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হলে সে ওই শ্যালো ঘরের টিনের ছাপড়ার নিচে দাঁড়ায়। ঠিক এই অবস্থায় বজ্রপাত হয়। আমরা খবর পাওয়ার পরে সেখানে গিয়ে দেখি রিতু কাদা পানিতে পড়ে আছে। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত শাহ আলম এর বাবা নুরুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, আমার ছেলে শিবপুর গ্রামের মানুষের কাছে বোরো ধানের চারা বিক্রি করে। তারা সেই চারা তুলতে আসলে শাহ আলমও তাদের সঙ্গে যায়। এরপরেই বৃষ্টি শুরু হয়। পরে আমরা জানতে পারি শাহ আলম বজ্রপাতে মারা গেছে। শাহ আলমের সঙ্গে একই গ্রামের আরও তিনজন মারা গেছে। মারা গেছেন চারা তুলতে আসা শিবপুর গ্রামেরও ৫ জন।
নিহত মারিয়ার বাবা বলেন, আমি কাজে ছিলাম। এর মধ্যে বাড়ি থেকে খবর আসলো মেয়ে বজ্রপাতে আহত হয়েছে। পরে বাড়িতে এসে শুনি আমার মেয়ে আর নেই। পরে কাল রাতেই তাকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নিহত শাহ আলমের মেয়ে ও নিহত রিতুর বান্ধবী সম্পা খাতুন বলে, বজ্রপাতে একদিকে যেমন বাবাকে হারিয়েছি তেমনই একই ঘটনায় হারিয়েছি আমার বান্ধবীকেও। এই অবস্থা বোঝানোর মতো নয়।
অন্যদিকে শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন শাহ আলমের মা, ঋতুর মা, মারীয়ার মাসহ প্রায় সবাই। কথাও বলতে পারছেন না তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শুক্কুর প্রামানিকের ছেলে মো. মানিক হোসেন বলেন, বজ্রপাত দেখে সেখানে থাকা এক শিশু দৌড়ে এসে এ কথা বলে। বজ্রপাতের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমিই প্রথমে দৌড়ে সেখানে যাই। গিয়ে দেখি একেকজন একেক জায়গায় পড়ে আছে। এরপরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। পরে তারা এসে সবাইকে উদ্ধার করে নানান হাসপাতালে পাঠায়।
স্থানীয় মাটিকোড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানের খাদেম আজগর আলী বলেন, রাতেই নিহতদের জানাজা নামাজ সম্পন্ন করে রাত সাড়ে ১২ টা থেকে ১টার দিকে নিহতদের দাফন কার্য্য সম্পন্ন হয়।
পঞ্চক্রোশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, একই পরিবারের ৫ জন সহ এই ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা এলাকাবাসী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এলাকার সবার মাঝে একটা শোক কাজ করছে। নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। তাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাটাও যেন কারো জানা নেই।
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল হোসেন বলেন, এঘটনায় সর্বমোট ৯ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে দুইজন সম্পর্কে আপন ভাই ও চারজনের পিতা-পুত্র সম্পর্ক রয়েছে।
ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে এবং নিহতদের মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি শিশু ও কিশোরীও রয়েছে। এ সময় আহত হয় আরো ৪ জন।