জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি হলো ‘জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র’: ওয়ার্কার্স পার্টি
সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ :
‘বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠক আশাবাদ তৈরী করলেও তিস্তার কাঁটা রয়েই গেল। কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলনের সমঝোতা হলেও ব্রহ্মপুত্র বেসিনের পানি প্রবাহের কি হবে? তা অজানা থেকে গেল। অন্যদিকে গঙ্গার পানি চুক্তির ভবিষ্যৎ কি, তা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। তাই নদীর পানির প্রশ্নে বাংলাদেশ আশাবাদী হতে পারছে না। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে পানির গুরুত্ব অপরিসীম।’
চীন বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড মাও জে দং-এর ৪৬তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে “জনগণতন্ত্র: তত্ত্ব ও প্রয়োগ” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সংগ্রামী সভাপতি জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষে বছরব্যাপি কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজ শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর ২০২২) সকাল সাড়ে ১০টা জাতীয় প্রেসক্লাবে জহুর হোসেন চৌধুরী হলে পার্টির মতাদর্শ ও প্রশিক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে এ অালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় অংশ নেন সমাজ গবেষক জনাব শামসুল হুদা। আলোচনা সভায় মূলপত্র উপস্থাপন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড শরীফ শামশির। সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য, মতাদর্শ ও প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান ড. সুশান্ত দাস। সভা সঞ্চালন করেন পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড কামরূল আহসান।
কমরেড মেনন আরোও বলেন, গোডাউনে সার থাকলে, তা যদি কৃষকের কাছে না পৌঁছায়, তাতে কোন লাভ হবে না। সময়মত সেচের পানি না পেলে ফসল উৎপাদন মার খাবে।
তিনি বলেন, মন্ত্রীরা চালের মজুদ নিশ্চিতের কথা বলছেন, অথচ এখন মোটা চালের মূল্য ৬০/৬৫ টাকা। মূল্যস্ফীতি ক্রমশইঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা খুবই দুর্বল। সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তৈরী হয়েছে।
তিনি পার্টির ২১ দফা কর্মসূচিকে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে’র আলোকে তৈরী বলে একে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য পার্টির নেতা, কর্মীদের আহবান জানান।
বিশিষ্ট সমাজ গবেষক শামসুল হুদা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অতীত নিয়ে বসবাস করছে। অতীত বিশ্লেষন করেই বর্তমানকে এগুতে হয়। মানুষ বর্তমানকালে বসবাস করে। বর্তমানই ভবিষৎ নির্ধারণ করে।
তিনি বলেন, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও চীন বিপ্লব মানব ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল। কমরেড মাও সেতুং ‘জনগণতান্ত্রিক’ কর্মসূচির মাধ্যমে চিনের বৈপ্লাবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। জনগণকে সংগঠিত করে পশ্চিমা আশিবাদপুষ্ট ‘কুয়োমিনতাং’ সেনাবাহিনী ও চিয়াংকাই শোকের শাসনের বিরুদ্ধে লাল ফৌজ গঠন করে লংমার্চ করেন তা ছিল অবিস্মরণীয় উদ্ভাবন।
মূলপত্র উপস্থাপন করে কমরেড শরীফ শমশির বলেন, “কমরেড মাও সেতুঙের নয়াগণতন্ত্র বা জনগণের একনায়কত্ব যা জনগণতন্ত্রের নির্যাসকে ধারণ করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চীনের মতো পশ্চাদপদ অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে সফল হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের দুশ’ বছরের বৃটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকার এবং তেইশ বছরের পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রের অধীনে প্রায় উপনিবেশের আবহে জনগণতন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হলেও বাংলাদেশে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সফলতা আসে নি। মার্কস-এঙ্গেলসের মহান বিপ্লবী চিন্তাধারার ধারাবাহিকতায় লেনিন রাশিয়ার মতো পশ্চাদপদ পুঁজিবাদী দেশে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। মার্কসবাদী দর্শনের অধ্যয়ন এবং লেনিনের প্রায়োগিক সফলতার ধারাবাহিকতায় মাও সেতুঙ রাশিয়ার চেয়েও পশ্চাদপদ দেশ চীনে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্রের পথকে বেগবান করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয়, শ্রেণি ও রাষ্ট্র প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বিভক্তি এবং অতিবাম ঝোঁকের কারণে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি সফল হয়নি। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জনগণতন্ত্রের রাজনৈতিক দাবিসমূহের প্রভাব ছিল। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচিতে যেমন সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিল তেমনি ৬-দফার সঙ্গে ১১ দফাকেও তারা স্বীকার করে নেয়। ১১দফায় শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক দাবির উল্লেখ ছিল। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময়েও জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয় প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল সেখানেও জনগণতন্ত্রের প্রভাব ছিল। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে বলা যায় এখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় চারটি মূলনীতির অন্যতম হলো গণতন্ত্র। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১-এ গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকারকে যুক্ত করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” এর সঙ্গে অনুচ্ছেদ ৭-এর সংবিধানের প্রাধান্য অংশটুকু সংযুক্ত করলে তা আরো পরিষ্কার হবে, যেমন তাতে উল্লেখ আছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।”
কমরেড কামরূল আহসান বলেন, ‘জনগণতান্ত্রিক’ বিপ্লবের কর্মসূচি হলো সাম্যবাদের অভিমুখে যাত্রা পথ রচনা আর সাম্যবাদ হলো পুঁজিবাদ থেকে মানুষের শোষণ মুক্তি।
সভাপতির বক্তব্যে ড. সুশান্ত দাস বলেন, কমরেড মাও সেতুং ‘জনগণতান্ত্রিক’ কর্মসূচি প্রয়োগে নিয়ে আধুনিক চিনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৪০ সালে তিনি ‘নয়া গণতন্ত্রের’ যে ধারণা দেন তা ছিল ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিকল্প’। তিনি চিনে বিকল্প সমাজের শক্তির বিন্যাস ও বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার কাজটি হাতে কলমে তৈরী করেছেন এবং বাস্তবে তা অনুশীলনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও সাযূজ্যপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টির বাস্তবরূপে প্রতিফলিত করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবায়তায় ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচির ধারনা জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। এবং আজকের তরুণ প্রজন্মকে এই দায়িত্ব দিতে হবে।