প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৫
দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক বিমান চলাচলকে কেন্দ্র করে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া একদিকে দাবি করছে, চীনের একটি যুদ্ধবিমান তাদের একটি বিমানকে “অনিরাপদ ও অপেশাদার” আচরণ দেখিয়েছে, অন্যদিকে চীন পাল্টা অভিযোগ এনেছে যে অস্ট্রেলিয়ার বিমান চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং এখন তা ঢাকার চেষ্টা করছে।
চীনের অভিযোগ: “অস্ট্রেলিয়া চীনা আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে”
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জিয়াং বিন মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, তারা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটি “গম্ভীর কূটনৈতিক প্রতিবাদ” দায়ের করেছে। তিনি বলেন
“অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বিমান আমাদের সার্বভৌম আকাশসীমায় বেআইনি অনুপ্রবেশ করেছে। অথচ তারা সেটি ঢাকতে উল্টো চীনের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।”
জিয়াং আরও দাবি করেন, এই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ চীন সাগরের শিসা দ্বীপপুঞ্জের (Xisha Islands) আকাশসীমায়, যেটি চীন তাদের হাইনান প্রদেশের অংশ হিসেবে দাবি করে থাকে। চীন মনে করে, এই অঞ্চল তাদের সার্বভৌম অধীনের মধ্যে পড়ে এবং সেখানে অন্য কোনো দেশের সামরিক উপস্থিতি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সামিল।
চীন অস্ট্রেলিয়াকে সতর্ক করে বলেছে যে, তারা যেন নিজেদের নৌ ও বিমান বাহিনীর “সামনের সারির ইউনিটগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখে”, এবং এমন আচরণ না করে যাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
অস্ট্রেলিয়ার পাল্টা দাবি: “চীনের আচরণ অনিরাপদ ও অপেশাদার”
এর আগে, সোমবার (২০ অক্টোবর) অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে জানায়, তাদের একটি RAAF P-8A Poseidonনজরদারি বিমান দক্ষিণ চীন সাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমার উপর নজরদারি চালানোর সময় একটি চীনা যুদ্ধবিমান অত্যন্ত কাছে এসে ফ্লেয়ার ছোড়ে, যা বিমানটির নিরাপত্তা ও মিশনের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়
“এই আচরণ আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় নিয়মিত নজরদারিমূলক কার্যক্রমের প্রতি একটি সরাসরি হুমকি এবং একটি অনিরাপদ ও অপেশাদার আচরণ।
তারা আরও উল্লেখ করে যে, অস্ট্রেলিয়া বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক আইন মেনে দক্ষিণ চীন সাগরে সামুদ্রিক নজরদারি মিশন পরিচালনা করে আসছে। তারা এই অঞ্চলে নিজেদের সামরিক কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও আকাশসীমা ব্যবহারের অধিকার হিসেবেই দাবি করছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিবৃতিতে কোথায় এই ঘটনা ঘটেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, যা চীনের দাবি করা অবস্থানের বিপরীত। তবে এটি স্পষ্ট যে উভয় দেশই ঘটনাটির ব্যাখ্যা একেবারে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে।
বিরোধপূর্ণ অঞ্চল: শিসা দ্বীপপুঞ্জ (Xisha Islands) এবং দক্ষিণ চীন সাগর
শিসা দ্বীপপুঞ্জ, যাকে আন্তর্জাতিকভাবে Paracel Islands নামে ডাকা হয়, দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তরে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। চীন দীর্ঘদিন ধরেই এই দ্বীপপুঞ্জ নিজের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে এবং সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তবে এই অঞ্চলটি নিয়ে ভিয়েতনাম এবং তাইওয়ানও মালিকানা দাবি করে, যা একে একটি ভূরাজনৈতিক হটস্পট করে তুলেছে।
চীন এ অঞ্চলে তাদের সার্বভৌমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এই অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক জলসীমা হিসেবে দেখে থাকে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী মনোভাব এবং ‘Nine-Dash Line’ দাবিকে ঘিরে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। অস্ট্রেলিয়া AUKUS নিরাপত্তা চুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সমুদ্র নিরাপত্তা রক্ষায় জোটবদ্ধভাবে কাজ করছে। তাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকাটা নতুন কিছু নয়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এই ধরনের সামরিক উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে তা কোনও দুর্ঘটনা বা অপ্রত্যাশিত সংঘাতে রূপ নিতে পারে, যা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে।
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে সামরিক উত্তেজনা আবারও সামনে চলে এসেছে। উভয় দেশ একে অপরকে দোষারোপ করছে এবং ঘটনা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয়, বরং সমগ্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
যদি এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে তা বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।