মোঃ রেজাউল হক শাকিল, ব্রাহ্মণপাড়া ( কুমিল্লা ) প্রতিনিধি
দূর সম্পর্কের এক চাচার মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার একটি বাসায় কাজ করতে যান অভাবের সংসারে জন্ম নেওয়া কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার পাঁচ বছর বয়সী শিশু জোসনা। ঘটনাচক্রে সেখান থেকে দুই মাসের মাথায় হারিয়ে যান তিনি। পরে তিনি বড় হন অন্য এক পরিবারে। পরিবারটি তাকে বিয়েও দিয়েছেন।
স্বামী ও ইয়াসিন নামে একটি ছেলে সন্তান নিয়ে তিনি এখন গাজীপুরের দক্ষিণ সালনা এলাকায় বসবাস করছেন। স্বামী শহীদুল ইসলাম একটি প্রজেক্টে আর তিনি একটি পোশাক তৈরির কারখানায় চাকুরি করছেন। পরিবার হারনোর বেদনা বুকে চেপে হারিয়ে ফেলা পরিবার খুঁজে পেতে চেষ্টাও চালিয়ে ছিলেন তিনি। এরইমধ্যে কেটে গেছে ২৩ বছর।
অবশেষে আরজে কিবরিয়ার উপস্থাপনায় জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আপন ঠিকানা’র মাধ্যমে হারিয়ে ফেলা পরিবার ফিরে পেয়েছেন জোসনা। এতে জোসনার বুকে চেপে রাখা স্বজন হারানোর বেদনার অবসান হয়। জোসনা উপজেলার সাহেবাবাদ ইউনিয়নের ছাতিয়ানী এলাকার মো. আবুল হাসেমের মেয়ে। ‘আপন ঠিকানা’র ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা ভিডিও থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডের নির্মাণে ইউটিউব চ্যানেল ‘আপন ঠিকানা’য় আপলোড করা ভিডিওতে দেখা যায়, দীর্ঘ ২৩ বছর পর মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন দীর্ঘ ২৩ বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা জোসনা। দীর্ঘ বছর পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলনের আবেগঘন এ দৃশ্য আপ্লূত করেছে নেট দুনিয়ার প্রায় লাখও দর্শককে। ভিডিওটি ইউটিউব চ্যানেল ‘আপন ঠিকানা’য় গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রচার করা হয়। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি ‘আপন ঠিকানা’য় জোসনা তার হারিয়ে যাওয়ার করুণ গল্প তুলে ধরেন। তারপর থেকে জোসনার দেওয়া আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে ‘আপন ঠিকানা’ কর্তৃপক্ষ জোসনার পরিবার খোঁজার কাজে উঠে পড়ে লাগেন এবং অবশেষে জোসনার হারিয়ে যাওয়া পরিবার খুঁজে বের করেন।
‘আপন ঠিকানা’র মাধ্যমে জোসনা জানান, ছোটবেলায় এক চাচার সঙ্গে আমার বাবাকে না জানিয়ে আমার মা আমাকে ২০০২ সালে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি বাসায় কাজে দেন। সেখানে আমি ঠিকমতো কাজ করতে পারতাম না বলে তারা আমাকে মারধর করত। এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন একাই আমাদের বাড়ি চলে যেতে পারবো ভেবে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আমি চিন্তায় পড়ে যাই কীভাবে বাড়ি যাব? আমি তো চিনি না। কোথায় আমাদের বাড়ি ? সবমিলিয়ে আমি ভয় পেয়ে যাই। এ সময় সড়ক দিয়ে একজন মহিলা হেঁটে যাচ্ছিলেন, আমি উপায়ান্তর না দেখে ওই মহিলার পেছনে পেছনে হাঁটা শুরু করি। ওই মহিলা প্রথমে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে ওই মহিলার পরিবারেই বছরখানেক থাকতে পারি। তারপর তারা আমাকে অন্য একটি পরিবারের হাতে তুলে দেন। সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারিনি। তারাও আমাকে আরেকটি পরিবারের হাতে তুলে দেন। অবশেষে ওই পরিবারেই আমি বড় হই। তারা আমাকে বিয়েসাদী দিয়ে দেন। বর্তমানে আমার স্বামী ও একটি ছোট ছেলে রয়েছে।
জোসনা বলেন, মা-বাবার পরিচয় ছিল না বলে অনেকভাবে আমাকে অনেক কটুকথা শুনতে হয়েছে। মা-বাবার পরিচয় না থাকায় পড়াশোনা করতে পারিনি। দেশের নাগরিকও হতে পারিনি। ‘আপন ঠিকানা’র কর্তৃপক্ষসহ আমার হারিয়ে যাওয়া পরিবার খোঁজায় যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে আমার অফিসের শামীম ভাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তিনি আমাকে যে ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করেছেন এজন্য।
আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকার ওই ভিডিওতে বলেন, ‘আপন ঠিকানা’ বিগত চার বছরে সাড়ে চারশোর কাছাকাছি ছেলে মেয়েকে তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের একটি আত্মতৃপ্তির জায়গা। এই মহান কাজটি আল্লাহ তায়ালা আমাদের দ্বারা করিয়েছেন। এ জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। অনেকেই অবাক হন এসব সফল ভিডিও ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। যাদের কেউ হারিয়ে গেছে সে ধরনের পরিবার এখন অপেক্ষায় থাকেন কবে তাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে এই অনুষ্ঠানে দেখা যাবে। আমরা আশা করছি এই সফলতার সংখ্যা আরও বেশি অবাক করবে ভবিষ্যতে।