সিলেট ব্যুরো:- সিলেট নগরীর টিলাগড় আলুরতলে এলাকায় গোপন দরপত্রের মাধ্যমে ইকোপার্কের ইজারা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কাজে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সুত্র থেকে জানা গেছে। পুর্বে এই পার্কের ইজারাদার ছিলেন, সিলেট মহানগর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুবেদুর রহমান মুন্না। প্রায় তিন বছর ধরে এরখম গোপনন দরপত্রের মাধ্যনে সিলেট বন বিভাগের টিলাগড় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইজারা নিয়ে পরিচালনা করে আসছিলেন যুবলীগ ক্যাডার সুবেদুর রহমান মুন্না।

কিন্তু গত ৫ আগষ্টের পর মুন্না গা ঢাকা দিলে ইকো পার্কের সেই তথাকথিত ইজারারও সমাপ্তি ঘটে। ইজারাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রাণীর নিরাপত্তাহীনতায় বন্ধ ঘোষণা করা হয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পরপরই বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ কেন্দ্রের ইজারা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। কোন ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই গোপন দরপত্রের মাধ্যমে নগরীর টিলাগড় কালাশিল এলাকার মোঃ শাহ জালালের মাধ্যমে ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা বন্দোবস্ত দেয়া হয়। দরপত্র আহবান বা অন্য কেউ অংশগ্রহন ছাড়াই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন কবির গোপনে দরপত্রের নোটিশ তৈরী করে নিজেরাই দরপত্রে অংশ নিয়ে শাহ জালালকে ইজারা প্রদান করেন বলে বন অফিস সুত্রে জানা গেছে।

যেভাবে বন্য প্রানী সংরক্ষন কেন্দ্র হল পার্ক:- টিলাগড় আলুরতল এলাকায় অবস্হিত ৪৫ দশমিক ৩৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে রয়েছে বনাঞ্চল ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র। যা সিলেট বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন এলাকাটি সর্ব সাধারনের জন্য উম্মুক্ত ছিল। নামও দেয়া হয়েছিল “ইকোপার্ক”। সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন স্হান থেকে বিকেলে লোকজন আসতেন একটু হাওয়া খেতে। আর এই লোকজনের আসা যাওয়াকে কেন্দ্র করে বন বিভাগকে ম্যানেজ করে এই বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রকে বানানো হয় বিনোদন পার্ক।
ইজারা প্রথা:- সিলেট মহানগর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুবেদুর রহমান মুন্না তার প্রভু ও পিতৃতুল্য মহানগর আওয়ামিলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদকে দিয়ে ইজারার বন্দোবস্ত করান। সেই থেকে শুরু হয় ইজারা প্রথা। বন বিভাগের সংরক্ষিত বন্য প্রানী সংরক্ষণের বনের প্রবেশ মুখের অংশটি বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় প্রথম ইজারা পরিচালিত শুরু হয়। ইজারাদারের মাধ্যমে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকিট আদায়ের কাজের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়।
যুবলীগ ক্যাডার মুন্নার কব্জায় তিন বছর:- বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় তিন বছর ধরে সিলেট বন বিভাগের টিলাগড় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইজারা নিয়ে পরিচালনা করে আসছিলেন যুবলীগ ক্যাডার সুবেদুর রহমান মুন্না। তখন রাজনৈতিক দাপট খাটিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া ইজারা নিয়েছিলেন। ইজারা নিয়ে শুধু নিজেদের ব্যবসার দিকটিই নজর রেখেছিলেন। তার লোকজন সংরক্ষণ কেন্দ্রে রক্ষিত প্রাণীদের তদারকির গুরুত্ব দেয়নি। তার প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেওয়ার পর সংরক্ষণ কেন্দ্রের দুটি জেব্রা, পাঁচটি ময়ূর, ১১টি কই কার্প মাছ, চারটি খরগোশ মারা গেছে। টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য দাবি, দর্শনার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগও ছিল ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কিন্তু এরপরও তিনি দাপটের সঙ্গে কথিত ইজারার নাম ভাঙ্গিয়ে তার ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। ইকো পার্ক নামের পাশাপাশি এই বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি মুন্নার পার্ক হিসেবে সবাই চিনত। তিনি একটানা ৩ বছর তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ইজারা নিয়ে ইচ্ছামত ব্যবসা করেছেন। অতীতের এই ইকো পার্কে চুরি ছিনতাইসহ নানা অসামাজিক কর্মকান্ডের জন্ম দিয়েছিলেন এই মুন্না।
পট পরিবর্তনের সাথে সাথে হাত বদল:- যুবলীগ ক্যাডার সুবেদুর রহমান মুন্না গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান। সেই সাথে ইকো পার্কের তথাকথিত ইজারারও সমাপ্তি ঘটে।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই দাপুটে ইজারাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রাণীর নিরাপত্তাহীনতায় বন্ধ ঘোষণা করা হয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি।
সম্প্রতি বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ইকো পার্কের দায়িত্ব নিয়েছেন টিলাগড় কালাশিল এলাকার মোঃ শাহ জালাল। সুত্র জানায়, শাহ জালালের সাথে সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আরো দুই নেতাও অংশিদার হিসেবে রয়েছেন।
জানা যায়, সেই আগের মতই কোন ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করেই বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা শুধু মাত্র অফিসের ফাইলে বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে ইজারা দেন।
বন বিভাগের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায়, ইকো পার্কের সর্বশেষ দরপত্র আহবান করা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারী। এরপর ইকোপার্কের আর কোন দরপত্র আহবানের নোটিশ বন বিভাগের ওয়েব সাইটে পাওয়া যায়নি। তাদের ওয়েব সাইটে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারী থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র তিনটি দরপত্র নোটিশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইকোপার্কের কোন নোটিশ বা দরপত্র নাই।
এক বছর মেয়াদী ইজারা, মেলার আহবান:- এক বছর মেয়াদে ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় গত ১৬ মার্চ ইজারা বন্দোবস্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে বৈশাখী মেলায় স্টল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এ ঘোষণার সপ্তাহ দিন পর স্টল বরাদ্দ দিতে গত সোমবার ‘ফেসবুক লাইভ’ আয়োজন করা হয়। এতে দেখা গেছে, সংরক্ষণ কেন্দ্রে যত্রতত্র স্থাপনা স্থাপন করে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পরবর্তিতে সিলেট বন বিভাগ বৈশাখি মেলার আয়োজন বন্দ করে দেয়।
কর্মী সংকটে ইজারাদার:- বৈশাখি মেলার ঘোষনা দেয়ার পর থেকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা ইজারাদারের নিয়োগ করা কর্মীরাও কাজে যাচ্ছেন না। এতে বিপাকে পড়ে বন বিভাগ। জনবলসংকট থাকায় ৪৫ দশমিক ৩৪ হেক্টর জায়গা ও বন্য প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিলেন মাত্র তিনজন।
সংরক্ষন না পকেটকরণ? সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পার্কের ভিতর সংস্কার চলছে। রং তুলি দিয়ে বিভিন্ন আলপনা আকা হয়েছে।প্রাণীদের জন্য নির্ধারিত খাঁচাগুলো খালি পড়ে আছে।
প্রাণীদের তদারকি করা এক কর্মচারী জানান, তিন বছর আগে প্রথম ইজারা নেওয়ার সময় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইজারাদার ২৯ জন কর্মী নিয়েছিলেন। পরে কমাতে কমাতে দুই মাস আগেও ১২ জন দায়িত্ব পালন করছিলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রাণী তদারকির চেয়ে দর্শনার্থীদের টিকিট বিক্রিতে বেশি ব্যস্ত থাকতেন।
দর্শনার্থীরা খাঁচায় রক্ষিত প্রাণীদের অযথা বিরক্ত করার পাশাপাশি মানবখাবার দিয়ে প্রাণীদের অসুস্থ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু ইজারাদার এসব দেখতেন না।
বন বিভাগের বক্তব্য:- সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গোপন দরপত্রের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ওয়েব সাইটেও আছে। কোন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান। তিন বছর না এক বছর ইজারা জানতে চাইলে বলেন ১ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন কবিরের তথ্য যাচাই করতে তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে চলতি বছরের ইকোপার্কের কোন দরপত্র বা নোটিশ খুজে পাওয়া যায়নি।
বহাল তবিয়তে মোঃ হুমায়ুন কবির:- মোঃ হুমায়ুন কবির তিনি সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর যোগদান করেন। জনশ্রোতি রয়েছে তিনি বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে আওয়ামিলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের মদদে বানিয়েছেন অঢেল সম্পদ। শুধু সিলেট নয় তিনি সিলেট বন বিভাগের আওতাধীন সব থানা ও সিলেট বিভাগের সকল জেলায় ক্ষমতা কাটিয়ে কামিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তিনি গত ৫ আগষ্টের পুর্বে বিনা দরপত্রে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের অনেক ইজারা ও কাজ দিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি তার পদের চেয়ারটাকে আকড়ে ধরে নিয়েছেন নানামুখি ফায়দা। এবার পট পরিবর্তনের পর তিনিও খোলস পাল্টিয়ে তার পদ ধরে রাখার জন্য গোপন দরপত্র দিয়ে মন জয় করার চেষ্টা করছেন বলে সুত্র জানায়।
এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহন করব।