সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং এটি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রমের মধ্যে একটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করছে। দেশে ৩৩ লাখ বয়স্ক নাগরিক এবং ২৫ লাখ বিধবা ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা ভাতা পাচ্ছেন না, অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক এবং ৩৩ শতাংশ বিধবা যারা ভাতা পাওয়ার জন্য অনুপযুক্ত, তারা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ, প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এর সমাধানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি শুধু অর্থনৈতিক অপচয় নয়, বরং দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ন্যায়বিচার এবং সেবা প্রাপ্যতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। এই বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা এবং সমাধানের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
১. ভাতা প্রাপ্তির যোগ্যতার নির্ধারণের প্রক্রিয়া পুনঃমূল্যায়ন:
সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক যোগ্য নাগরিক ভাতা পাচ্ছেন না, অথচ অনুপযুক্ত লোকজন নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এর জন্য সরকারের উচিত প্রাপ্যতা যাচাই করার জন্য একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং আধুনিক প্রক্রিয়া তৈরি করা। যেমন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাতা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম তৈরি করা।
প্রস্তাব:
- নিবন্ধিত ভাতা আবেদনকারীদের তথ্য আধুনিকায়ন করা, যাতে কোনো ভুল বা অবৈধ তথ্যের সুযোগ না থাকে।
- ভাতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি ব্যবহার, যেমন ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি, যাতে সময়মতো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়।
২. অনুপযুক্ত প্রাপকদে বিরুদ্ধে পদক্ষেপ:
যারা ভাতা পাওয়ার জন্য অনুপযুক্ত, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা অনুপযুক্ত হয়ে ভাতা পাচ্ছেন, যা একটি বড় সমস্যা। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যারা ভাতা প্রাপ্তির শর্ত পূরণ করেন না, তাদের ভাতা বন্ধ করা এবং প্রাপ্ত ভাতার তথ্য যাচাই করে ভুল প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি ব্যবস্থা গঠন করা উচিত।
প্রস্তাব:
- সঠিক যাচাই প্রক্রিয়া চালু করা এবং নিয়মিত পরিদর্শন।
- অনুপযুক্ত ভাতা প্রাপকরা যাতে পরবর্তীতে ভাতা না পান, সে জন্য তাদের শনাক্ত করা।
৩. অতিরিক্ত খরচ কমানো:
প্রতিবছর দেড় হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে, যা সরকারী খাতে একটি বিশাল পরিমাণ। এই টাকা দেশের অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হতে পারত এবং আরও কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারত। অতিরিক্ত খরচ কমাতে, সরকারের উচিত ভাতা বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যাতে খরচটি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
প্রস্তাব:
- ভাতা বিতরণের পদ্ধতি আরও স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য করতে হবে।
- খরচের অপ্রয়োজনীয় অংশ কমানোর জন্য তথ্য-ভিত্তিক এবং নমনীয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর গুণগত মান উন্নয়ন:
শুধু সংখ্যাগত বেনিফিট নয়, সরকারের উচিত ভাতা প্রদান প্রক্রিয়ায় আরও গুণগত পরিবর্তন আনা। এতে শুধুমাত্র অর্থ নয়, দরিদ্র, বয়স্ক এবং বিধবা নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে।
প্রস্তাব:
- আরও ব্যাপক এবং সংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রণয়ন, যা শুধু অর্থ প্রদান নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা নিশ্চিত করবে।
- অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগণের জন্য সমন্বিত সেবা প্রদান।
৫. ভাতা প্রাপ্তির তথ্যের স্বচ্ছতা এবং নাগরিকদের সচেতনতা:
নাগরিকদের জন্য ভাতা প্রাপ্তির তথ্য ও প্রক্রিয়া সহজ এবং স্বচ্ছ হওয়া উচিত। অনেক সময় ভাতা প্রাপ্তির শর্ত সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকার কারণে যোগ্য ব্যক্তি ভাতা আবেদন করতে পারেন না। এক্ষেত্রে, সরকারের উচিত এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং ভাতা বিতরণে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করা।
প্রস্তাব:
- স্থানীয় সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।
- গণমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তথ্য প্রচার করা।
৬. বিস্তৃত তদন্ত ও গবেষণা:
বর্তমান পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক অপচয় নয়, বরং এটি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা নীতির অযোগ্যতা এবং দুর্বলতা প্রদর্শন করছে। সিপিডি’র মত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে রিপোর্ট দিচ্ছে, তবে এই ধরনের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি, আরও বিস্তৃত গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ে তদন্তের প্রয়োজন।
প্রস্তাব:
- সিপিডি বা অন্যান্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আরও গবেষণা চালানো এবং সমস্যার গভীরে গিয়ে তা সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া।
এই পরিস্থিতি সরকারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং এটি সমাধান করার জন্য সরকারকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাতা প্রাপ্তির যোগ্যতা সঠিকভাবে নির্ধারণ, অনুপযুক্ত প্রাপকদের শনাক্তকরণ এবং অতিরিক্ত খরচ কমানো একমাত্র উপায়, যাতে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কার্যকর এবং সুশাসিত হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনগণের উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।