জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ
জয়পুরহাটে ছাত্র আন্দোলনে ‘হত্যা মামলার আসামি’ হয়েও প্রশাসনের নাকের ঠগায় পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ হল সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামীলীগ নেতা জুলফিকার আলী রনি। হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামী হয়ে জামিন না নিয়ে প্রকাশ্যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা থাকার পরেও কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ ঢাকা ফজলুল হক মনি সহকারী পরিচালক কলেজ (২) স্বাক্ষরিত ১৮-৩-২৫ তারিখে এই আদেশ দেওয়া হয়৷
২০২৫ সালের ১৮ই মার্চ ক্ষেতলাল সরকারি পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পান আওয়ামীলীগ নেতা জুলফিকার আলী রনি। রনি জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এর আগে তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলার আসামি ও আওয়ামী লীগের দোসর হয়েও কিভাবে ঐতিহ্যবাহী ক্ষেতলাল পাইলট স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষা অনুরাগী শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
জুলফিকার আলী রনি কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ঘনিষ্ঠজন ও আস্থাভাজন হওয়ায় ক্ষমতার দাপটে কোন প্রকার নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়ায় ২০১৩ সালে ক্ষেতলাল পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান) পদে যোগদান করেন। কলেজে যোগদান করার পরও তিনি আওয়ামীলীগের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ঘনিষ্ঠজন ও আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তিনি দুইবার (সভাপতি দুদু-সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান ও সভাপতি রকেট-সাধারণ সম্পাদক জাকির মেয়াদে) আওয়ামীলীগের উপ-দপ্তর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও পর্যন্ত সভাপতি রকেট-সাধারণ সম্পাদক জাকির কমিটির দায়িত্বে আছেন। রনি আওয়ামীলীগের ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন সরকারি জায়গা দখল করাসহ নিষিদ্ধ সংগঠন কাদা-মাটি গ্রুপের একটি অংশ তার নির্দেশনায় পরিচালিত হত বলে অভিযোগ রয়েছে। এই নিষিদ্ধ সংগঠন কাদা-মাটি গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন সময় বিএনপি অফিস পুড়ানোসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদেরও নির্যাতন করেছে যার নেতৃত্ব দিয়েছেন জুলফিকার আলী রনি নামের এই আওয়ামীলীগ নেতা।
জুলফিকার আলী রনি ছাত্র বিশাল হত্যা মামলার ১৬২ নম্বর আসামি। এছাড়াও জয়পুরহাট সদর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি বিস্ফোরক মামলাও রয়েছে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জয়পুরহাট শহরের পাচুঁর মোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করে। পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের মতলবের ছেলে ছাত্র বিশাল ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বগুড়ায় রওনা দিলে পথিমধ্য ছাত্র বিশাল মারা যান। এ ঘটনায় বিশালের বাবা জয়পুরহাট চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী বলেন, ‘জুলফিকার আলী আওয়ামী লীগের দোসর। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি হত্যা মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তা না করে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। এটা মেনে নেয়া যায় না।’
ক্ষেতলাল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ইমরান সহ একাধিক শিক্ষক কর্মচারীরা বলেন , জুলফিকার আলী জৈষ্ঠতার ভিত্তিতে মন্ত্রনালয় থেকে দায়িত্ব পেয়েছেন। তার নামে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলা রয়েছে এটা আমরা জানি না আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। যদি সে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকে এবং তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়ে থাকে। তাহলে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া মোটেই সমীচীন হয়নি। ছাত্রদের জীবনের বিনিময়ে আজকে আমরা স্বাধীনভাবে শিক্ষকতা করতে পারছি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আব্বাস আলী বলেন, অধ্যক্ষ জুলফিকার আলী একজন ছাত্রলীগ কর্মী ও আওয়ামীলীগের দীর্ঘদিনের পদ-পদবির সাথে যুক্ত রয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলা রয়েছে। তাকে যারা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন। তারাও স্বৈরাচারের দোসর। যাচাই-বাছাই না করে একজন হত্যা মামলার আসামীকে মন্ত্রনালয় থেকে কিভাবে পদায়ন করে এই দায় তারা কিছুতেই এড়াতে পারে না আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
ক্ষেতলাল সরকারি পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পদায়নপ্রাপ্ত জুলফিকার আলী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে করা একটি হত্যা মামলা আমার বিরুদ্ধে হয়েছে। ২০১৩ সালে কলেজে ঢুকেছি এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগ করেছি। ২০২২ সাল থেকে কলেজ সরকারি হওয়ার পর থেকে আমি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না। হত্যা মামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। জৈষ্ঠতার ভিত্তিতে মন্ত্রনালয় থেকে দায়িত্ব পেয়েছি।
জয়পুরহাট জেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি মামলা বা এ বিষয়ে কিছু জানি না। তবে আপনার কাছ থেকে শুনলাম, বিষয়টি জেনে আপনাকে জানায় বলে তিনি জানান।
জয়পুরহাট জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, অধ্যক্ষ জুলফিকার আলীর মামলাটি তদন্তাধীন আছে। তদন্তে ওনি যদি জড়িত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ক্ষেতলাল সরকারি পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি আসিফ আল জিনাত বলেন, হল সুপারের দায়িত্বে থাকা অধ্যক্ষ জুলফিকার আলীর বিরুদ্ধে যে হত্যা মামলা রয়েছে এ বিষয়ে আমরা জানি না। জানলে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো না। আর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এটা মন্ত্রনালয়ের ব্যাপার। পরীক্ষা যেহেতু শুরু হয়েছে এই বিষয়গুলোও আমাদের খেয়াল করতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ অতিরিক্ত-সচিব (মাধ্যমিক অনুবিভাগ-২): মোঃ মিজানুর রহমানের সরকারি মুঠো ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি৷