সত্যজিৎ দাস:
“চৈত্র সংক্রান্তি” বাংলার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক অমূল্য সময়। এটি শুধু ঋতু পরিবর্তন এবং সূর্যের রাশিচক্র পরিবর্তন নয়,বরং মানুষের আত্মিক উন্নতির জন্য এক বিশেষ তিথি। এই দিনটি আমাদের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা অর্জনের জন্য এক মহামুহূর্ত, যা সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।
প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী,সংক্রান্তি হল সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশের সময়। চৈত্র সংক্রান্তি তখন ঘটে যখন সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এটি বৈদিক সৌরবছরের সূচনা হিসেবে পরিচিত। শাস্ত্র মতে, এই সময় শরীর, মন ও আত্মা বিশুদ্ধ করার জন্য পুণ্যকর্ম করা অত্যন্ত ফলদায়ী।
ঋগ্বেদ (১০.১৮.১)-এ বলা হয়েছে:
“ঋতুচক্র পরিবর্তনের কালে,শুদ্ধ আহার ও সংযমী জীবনচর্চা—মানুষকে আত্মিক উন্নতির পথে এগিয়ে দেয়।”
এছাড়া,মনুসংহিতা (৪/২৪৯)-এ বলা হয়েছে: “সংক্রান্তি, অয়ন,পূর্ণিমা ও অমাবস্যা—এই তিথিগুলোতে সংযম, স্নান,দান ও উপবাস বহু গুণে ফলপ্রসূ।”
এই তিথির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অনুভব করতে হলে, তা শুধু বাহ্যিক শুদ্ধতার ক্ষেত্রে নয়,বরং অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়াতেও সক্রিয় হতে হবে।
গরুড় পুরাণ-এ সংক্রান্তি তিথিকে “অশুচি দেহকে পবিত্র করার মহামুহূর্ত” হিসেবে বর্ণিত করা হয়েছে। এতে পঞ্চশাক বা পঞ্চান আহারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চশাক,যা সাধারণত ৫ ধরনের শাকসবজি দিয়ে তৈরি হয়,আমাদের শরীরের তাপশক্তি এবং ভেতরের বিষাক্ততা দূর করতে সহায়তা করে।
এছাড়া,এই তিথির শুদ্ধতার সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি রয়েছে,যা বলছে: “সংক্রান্তির দিনে পঞ্চশাক ও মূলভূজ আহার পিতৃতর্পণে শ্রেষ্ঠ।”
এটি শুদ্ধ আহারের প্রতি এক বিশেষ নির্দেশনা,যা শুধু শারীরিক বিশুদ্ধতা নয়,আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতারও প্রতীক।
শিব পুরাণ-এর বিধ্বংস খণ্ড-এ উল্লেখ করা হয়েছে:
“দুঃখ যদি অন্যের মাধ্যমে জানো,তাহলে তাও জ্ঞান নয়।
নিজের অনুভবে,দেহে ও হৃদয়ে যে দুঃখ উপলব্ধি করে—
সে-ই সত্যে উত্তীর্ণ হয়।”
এই শ্লোকের মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে যে,দুঃখ এবং কষ্টকে বাহ্যিক ভাবে না দেখে,তা অভ্যন্তরীণভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। চৈত্র সংক্রান্তি একটি উপলব্ধির সময়,যখন আমরা আমাদের শরীর, মন এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি। পঞ্চান আহার এই উপলব্ধির সাথে যুক্ত, কারণ এটি আমাদের ভেতরের অশুদ্ধতা, অম্লতা ও অতৃপ্তি দূর করতে সহায়তা করে।
ভগবত গীতা (১৭.২৩)-এর একটি বিশেষ শ্লোক এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক: “আহার শুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ। স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থিনাং বিমোক্ষঃ॥”
এই শ্লোকের মাধ্যমে বলা হয়েছে,শুদ্ধ আহার শরীরের শুদ্ধি নিশ্চিত করে এবং শরীর শুদ্ধ হলে সত্ত্বা শুদ্ধ হয়,যা স্মৃতি ও আত্মজ্ঞানকে উন্নত করে। এর ফলে,মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটে এবং জীবনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ও সংকট দূর হয়ে যায়।
এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে,শুদ্ধ আহারের মাধ্যমে আমরা শুধু শরীর নয়,আমাদের চিন্তাভাবনাও পরিশ্রুত করতে সক্ষম হই। এই শুদ্ধ আহারের অন্যতম মাধ্যম হল “পঞ্চান”,যা চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ খাদ্য।
চৈত্র সংক্রান্তির পঞ্চান তৈরিতে সাধারণত ঋতু উপযোগী শাকসবজি ব্যবহার করা হয়,যা শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে কিছু উপাদান হলো:
১) করলা: তিতো এবং রক্তশোধক,হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
২) পেঁপে: কাঁচা পেঁপে গ্যাস্ট্রিক ও কফ দূর করে।
৩) বেগুন: সহজপাচ্য,শরীর ঠাণ্ডা রাখে।
৪) লাউ: পিত্তনাশক, হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী।
৫) সজনে ডাঁটা: হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে।
৬) পুঁই শাক: কাশি ও কফ কমাতে সহায়ক।
৭) চালকুমড়া: মাথাব্যথা ও ঘুমের সমস্যা সমাধান করে।
৮) শিম: কোষ্ঠবদ্ধতা কমায়।
৯) কলার মোচা: রক্ত পরিষ্কার করে।
১০) মিষ্টি কুমড়া: মস্তিষ্ককে শীতল রাখে।
এই উপাদানগুলো একত্রে সরষে তেল,শুকনো লঙ্কা এবং তেজপাতার সাথে রান্না করা হয়। তবে পেঁয়াজ এবং রসুন সাধারণত বর্জনীয়,কারণ এটি শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
পাঁচনের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা:-
– শরীর থেকে টক্সিন দূর করা।
– হজমশক্তি বৃদ্ধি করা।
– গ্রীষ্মের তাপে মানসিক অস্থিরতা কমানো।
– রসনার সংযম তৈরি করা।
– শোক, ক্ষোভ ও হতাশার আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা।
চৈত্র সংক্রান্তির পাঁচন আমাদের শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়,শুদ্ধ জীবন এবং শুদ্ধ আহারের মধ্যে এক অমূল্য সম্পর্ক বিদ্যমান। এই একক পন্থা শরীরের শুদ্ধতা এবং আত্মিক উন্নতির দিকে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে।
আসুন,এবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে আমরা কেবল শরীর নয়, আত্মাকেও শুদ্ধ করি পঞ্চান আহারের মাধ্যমে এবং আত্মিক জ্ঞানে এগিয়ে চলি। শুদ্ধ আহারে শুদ্ধ জীবন.. এটাই আমাদের সংস্কৃতির মূল কথা।