সত্যজিৎ দাস:
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা আর দশটা সাধারণ পেশার মতো নয়,বরং এটি এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার এক বিপজ্জনক ক্ষেত্র। ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের গতকাল পর্যন্ত সাংবাদিকরা শারীরিক নির্যাতন,মিথ্যা মামলা এবং হত্যার মতো চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন। সম্প্রতি সাংবাদিক বিভু রঞ্জন সরকারের রহস্যজনক মৃত্যু এই সংকটকে নতুন করে সামনে এনেছে।
বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী,গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন,তার কিছু চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে ২ শতাধিক সাংবাদিক বিভিন্নভাবে হয়রানি,নির্যাতন,মামলা,হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন। (সূত্র: প্রথম আলো,৩ অক্টোবর ২০২৩)
আর্টিকেল ১৯: ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৩ শতাধিক সাংবাদিকের ওপর বিভিন্ন ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। (সূত্র: আর্টিকেল ১৯)
রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ (আরআরএজি): ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে ৮৭৮ জন সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এটি আগের বছরের তুলনায় ২৩০% বেশি। (সূত্র: দ্য হিন্দু,৪ আগস্ট ২০২৫)
আসক-এর রিপোর্ট: ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো,৩ অক্টোবর ২০২৩)
সাম্প্রতিক ঘটনা: ২০২৫ সালের আগস্টে গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করছে। (সূত্র: প্রথম আলো,৯ আগস্ট ২০২৫)
আরআরএজি-এর রিপোর্ট: এই সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৫৫৮% বেড়ে গেছে, যা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার একটি প্রধান হাতিয়ার। (সূত্র: দ্য হিন্দু,৪ আগস্ট ২০২৫)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ): অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং সিপিজে-এর মতো সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে যে, ডিএসএ বাতিল হলেও এর মতোই দমনমূলক আইন সিএসএ এখনো সাংবাদিকদের হয়রানির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। (সূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল,সিপিজে)
২০২৩ সালে ইত্তেফাকের জাকির হোসেন এবং ২০২৫ সালে যুগান্তরের মো. ফজলে রাব্বি ও আরটিভির সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। (সূত্র: দ্য ডেইলি ইত্তেফাক,২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩; দৈনিক আমাদের সময়,১৪ আগস্ট ২০২৫)
সাংবাদিকদের আত্মহত্যার সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বা পরিসংখ্যান কোনো আন্তর্জাতিক বা দেশীয় সংস্থার রিপোর্টে পাওয়া যায়নি। তবে,ঢাকার হাতিরঝিলে একজন সাংবাদিকের দেহ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়,যা তার পরিবারের সদস্য আত্মহত্যা বলে দাবি করেন। (সূত্র: আনন্দবাজার)
যখন সাংবাদিকদের জন্য এই চরম পরিস্থিতি বিরাজ করছে,ঠিক তখনই ২২ আগস্ট,২০২৫-এ সাংবাদিক বিভু রঞ্জন সরকারের আকস্মিক ও রহস্যজনক মৃত্যু দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যদিও কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছে, তার পরিবার ও সহকর্মীরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মতে,বিভু রঞ্জন ইতিহাস ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছিলেন এবং তিনি একাধিকবার তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
বিভু রঞ্জন সরকারের এই অকাল মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর চলমান দমন-পীড়ন ও ঝুঁকির একটি করুণ পরিণতি। তার মৃত্যু শুধু একজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়,বরং মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতি একটি বড় আঘাত।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অবিলম্বে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং নির্ভয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরিবেশ তৈরি করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা,হয়রানি এবং মিথ্যা মামলার প্রবণতা রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বিভু রঞ্জন সরকারের মৃত্যুর একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি। যদি সাংবাদিকরা নির্ভয়ে কাজ করতে না পারেন,তবে দেশের গণতন্ত্র এবং মুক্ত মত প্রকাশের অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।