বর্তমানে চলমান রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দাবী নিয়ে আন্দোলন, শিক্ষক সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি। ইতিমধ্যে দেশব্যাপী প্রতিটি জেলা থেকে তারা তাদের ১০ম গ্রেডের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। জেলা ও উপজেলায় প্রেসক্লাবের সামনে ১০ম গ্রেডের দাবীর পক্ষে মানববন্ধন কর্মসূচি শেষ করে তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় প্রেসক্লাবের সামনেও গত ১৯ অক্টোবর তাদের দাবী জানিয়েছেন। পরবর্তীতে গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিঃ দেশের তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক সমাবেশ করেন এবং সমাবেশ শেষে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে “March for 10th Grade”-এর ব্যানারে যাত্রা করেন। শিক্ষকদের এ দাবীর কথা চিন্তা করে ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে সংস্কার হিসেবে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কনসালটেশন কমিটি গঠন করেন। কিন্তু সেই কমিটিও আশানুরূপ কোন প্রস্তাব পেশ করেন নি, যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনঃক্ষুন্ন ও ক্ষোভের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য শিক্ষকেরা আরো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন ও আরো বৃহৎ আকারে শিক্ষক সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মূলত তারা নিজেদের কাজ ও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ম গ্রেড তথা ২য় শ্রেণির মর্যাদা দাবী করছেন। তাদের মতে, শিক্ষক যদি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হন তাহলে তাদের থেকে ১ম শ্রেণির নাগরিক তৈরি করা অবান্তর। তারা নিজেরাই যদি হীনমন্যতায় ভুগেন, দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হন তাহলে তারা শিক্ষার্থীকে উন্নত জীবনের আশা বা স্বপ্ন কিভাবে দেখাবেন? আর যদি দেখানও তাহলেও কি সেটা বাস্তবসম্মত হবে? মূলত একজন হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির থেকে আশা বা স্বপ্ন দেখানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করা অমূলক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উন্নত জীবনমানের ব্যাপারে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও লেখক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান একমত পোষণ করে বলেছেন, “প্রাথমিক স্তর হচ্ছে শিক্ষাজীবনের ভিত্তি, আর এই ভিত্তিকে মজবুত করতে এখানে বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে।”
শিক্ষকদের দাবী সহকারী শিক্ষকদের এন্ট্রিপদ ১০ম গ্রেড করা হলে তারা ২য় শ্রেণির কর্মচারী হবেন, এক্ষেত্রে তারা মর্যাদার পাশাপাশি আর্থিক দিক দিয়েও লাভবান হবেন। কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক প্রশান্তি আসবে। তাছাড়া একজন শিক্ষক যখন কর্মক্ষেত্রে মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকবেন তখন তার প্রধান দায়িত্ব শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে আরো নিবিড় মনোযোগ আসবে। এ ব্যাপারে বিএনপি’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষকদের যদি শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তাদের আর্থিক বিষয় নিয়ে বা সংসার চালানো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হয় তাহলে তার থেকে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা দুরূহ। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে।”
মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন ও মর্যাদা দিতে হবে, যেন তারা এ পেশায় এসে হীনমন্যতায় না ভোগেন। যতদিন পর্যন্ত এ পেশাকে মেধাবীদের জন্য আকর্ষণীয় করা না হবে ততদিন এই পেশা মেধাবীদের ট্রানজিট পেশা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তারা এই পেশায় যোগদান করবেন ঠিকই কিন্তু সুযোগ থাকলে অন্য পেশাতে চলে যাবেন এটাই বাস্তবতা। কারন বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে মাপা হয় অর্থ দিয়ে। সেখানে আপনি যতই শিক্ষকতা পেশাকে শুধু সম্মানের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করুন না কেন তা বাস্তবতার নিরিখে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্যই হবে। কারন শিক্ষকেরাও সমাজের অংশ, তারাও সমাজে সকলের সাথেই বসবাস করেন। তাদের শুধু সম্মান দিয়েই সংসার চলে না। তারা যখন দেখবে একইসাথে একই গ্রেডে ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে তাদের বন্ধু/ভাই/আত্মীয় স্বজনেরা চাকরি করে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়ে যাচ্ছেন আর সে/তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবেই রয়ে যাচ্ছেন, তখন তার ভিতরেও হতাশাবোধ জন্মাবে। তারও কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হবে। এজন্য মেধাবীরা সুযোগ থাকলে অন্য পেশায় চলে যাবে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে মেধাবীদের হাতেই কোন প্রতিষ্ঠান বা দেশের স্বনির্ভরতা বা সক্ষমতা নির্ভর করে। যেই প্রতিষ্ঠানে যত বেশি মেধাবীদের বিচরণ, সেই প্রতিষ্ঠান ততবেশি সৃজনশীল ও কর্মচঞ্চল এবং সেখান থেকে আউটপুটও হবে ততবেশি উন্নত মানের। এ ব্যাপারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জনাব সারজিস আলম বলেন, “গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন। একটা সরকারি চাকরি এইদিকে তার আগ্রহটা তৈরি করছে কিন্তু গ্রেড দেওয়া হচ্ছে ১৩ তম গ্রেড। ১৩ গ্রেডের ১৭/১৮ হাজার টাকার বেতন একজন গ্রাজুয়েটকে কতদিন একটি প্রাইমারি স্কুলে রাখবে? এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাই আমরা যদি আমাদের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও স্ট্রং করতে চাই, আমাদের গোড়াটাকে শক্ত করতে চাই, তাহলে সরকারি প্রাথমিক স্কুল এবং সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষকদের গ্রেড অন্তত ১০ম গেডে নিয়ে আসা উচিত। কারণ আমরা যদি আমাদের শিক্ষকদেরকে ওই সাপোর্টটা না দেই, সম্মানিত না করি, তাহলে খুব স্বভাবতই স্টুডেন্টদের পড়াশোনার প্রতি তাদের যে আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা সেটা তারা সেভাবে খুঁজে পাবে না এবং তাদেরকে জীবিকা নির্বাহের জন্যে অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাই দুই দিকে মনোযোগ দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের স্টুডেন্টদের যে কাঙ্খিত অগ্রগতি সেটা আমরা দেখতে পাবো না।”
ইতিমধ্যে দেখা গেছে রাষ্ট্রের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৪তম, ১৫তম, ১৬তম এমনকি ১৭তম গ্রেড থেকেও ১০ম গ্রেডের সুপারিশ করা হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু শিক্ষকরা প্রায় ৫-৬ বছর যাবৎ তাদের জীবনমান ও মর্যাদার জন্য দাবী উত্থাপন করে আসছেন, দাবীর পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন কিন্তু তাদের কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তেমন আমলে নিচ্ছেন না বরং তাদেরকে আরো চেপে ধরার নানা ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি করার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, যেটা সত্যিই হতাশাজনক!
শিক্ষকেরা কোটা সংস্কার বিধি ২০২৪’র আলোকে নিয়োগ বিধি ২০১৯ সংশোধন করতঃ সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রিপদ ধরে ১০ম গ্রেডসহ পরবর্তী পদে শতভাগ পদোন্নতি দাবী করছেন।
এছাড়াও তাদের যুক্তি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস হচ্ছে প্রশাসনিক কাজ সংক্রান্ত এজন্য
১) উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ৯ম গ্রেড ও
২) সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ১০ম গ্রেড।
আবার ইউ,আর,সি অফিস হচ্ছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত এজন্য
১) ইউ, আর, সি ইন্সট্রাক্টর ৯ম গ্রেড ও
২) সহকারী ইউ, আর, সি ইন্সট্রাক্টর ১০ম গ্রেড।
একইভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে একাডেমি সংক্রান্ত বা শিক্ষাদান সংক্রান্ত সেজন্য
১) প্রধান শিক্ষককে ৯ম ও
২) সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদান করা যৌক্তিক।
মূলত ৩টি প্রতিষ্ঠানের কাজ তিন ধরনের কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই তা হলো মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। তাহলে ঐ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সহকারীরা ৯ম ও ১০ম গ্রেড পেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের ৯ম ও ১০ম গ্রেড দিতে সমস্যা কোথায়? বরং এটা না দেওয়াই একটা চরম বৈষম্য। আবার একই পাঠ্যক্রম, একই পাঠ্যপুস্তক এবং একই শ্রেণিতে পাঠদান করে পিটিআইতে অবস্থিত পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড পাচ্ছেন, অন্যদিকে সারা বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেড। এটাও একটা চরম বৈষম্য।
পাশাপাশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংখ্যক সরকারি কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠান। এখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক সরকারি কর্মচারী রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত তাই এদের একইসাথে প্রমোশন দেওয়াও একটু জটিল। এক্ষেত্রে তাদের শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে বা ৫০ শতাংশ সিনিয়রিটির মাধ্যমে ও ৫০ শতাংশ বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। আবার বিভাগীয় প্রার্থীতা বলতে ৫০ শতাংশ প্রধান শিক্ষক ও ৫০ শতাংশ সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে গণ্য করে মেধাবী শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ রাখা উচিত বলে দাবী করছেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে যদি সবাইকে পদোন্নতি না দেওয়া যায় তাহলে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মত নির্দিষ্ট সময় পর পর সুপারনিউমারারি পদ্ধতির আলোকে উচ্চতর স্কেল প্রদান করে বেতন দেওয়া উচিত। কারন কোন কাজেই যদি স্বীকৃতি, প্রশংসা বা পুরষ্কার না থাকে তাহলে সেই কাজে নিয়োজিত কর্মীরা কোন মোটিভেশন পান না। আর মোটিভেশন না থাকলে সেই কাজের গতিও শ্লথ হয়ে যায়! প্রতিবছর উপজেলা, জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক/শিক্ষিকা নির্বাচিত করা হয় কিন্তু তাদেরকে মূলত কর্মক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরষ্কার দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে যদি তাদেরকে একটি করে ইনক্রিমেন্টও পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া হয় সেটাও তাদের জন্য মোটিভেশান হবে। মূলত এই ডিপার্টমেন্টে কাজের ক্ষেত্রে তেমন কোন স্বীকৃতি ও মোটিভেশান না থাকায় এই বিভাগে নিয়োজিত কর্মীরা দিনে দিনে চরম হতাশায় নিমজ্জিত। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে স্নাতক ২য় শ্রেণি বা সমমান। এই একই যোগ্যতায় সরকারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড বা ৩য় শ্রেণির করে রাখা হয়েছে। যা একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজে নিজের পেশার পরিচয় দিতে সবসময়ে তার হীনমন্যতায় মস্তক অবনত হতে হয়। অথচ একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে কতটা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে তার পেশার সার্থকতা বজায় রাখতে হয়। তাকে প্রতিনিয়ত শিশুদের সাথে ডিল করতে হয়, যেখানে একজন বাবা-মাকে তাদের ১/২ জন সন্তানকেই সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ গড়ে ৯০/১০০/১৫০/২০০/৩০০ বা ততোধিক জন ছাত্রছাত্রীদের সাথে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪.১৫ ঘন্টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কাটাতে হয় (যদিও শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বিদ্যালয়ভিত্তিক ভিন্নতা রয়েছে)। তাদের অভাব-অভিযোগ, নালিশ-বিচার, আবদার-আহ্লাদের কথা শুনতে হয়, তার প্রতিকার করতে হয়। এতটা মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পরেও এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ১৩তম গ্রেডে ৩য় শ্রেণির করে রাখা হয়েছে। যেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তাকে মাত্র ১৭৫৬০/- টাকা বেতনে চাকরি জীবন শুরু করতে হয়। এই স্বল্প বেতনে তার জীবনযাপন করতে ও বর্তমান বাজারদরের সাথে তাল মেলাতে তাকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ব্যয়ের সাথে আয়ের অনুপাত ব্যস্তানুপাতিক বা নিম্নমুখী। এজন্য দেশের অধিকাংশ শিক্ষকই বর্তমানে ঋণে জর্জরিত রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দৈনিক টিফিন ভাতা ৬.৬৭ টাকা! যা দিয়ে এককাপ চা পর্যন্ত পাওয়া যায় না! এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জনাব কামরুল হাসান মামুন বলেন, “যে মানুষটা আপনার সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন, যাকে আপনার সন্তানের পড়ালেখার দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই মানুষটাকে আপনি রাষ্ট্রের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী বানিয়ে রেখেছেন। তাকে টিফিনভাতা হিসেবে সাড়ে ছয় টাকা দিচ্ছেন, যা দিয়ে এককাপ চা’ও হয় না! এটা লজ্জা!”
এই সেক্টরে বেশির ভাগই গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষক। আবার অনেকেরই অনার্স ও মাস্টার্সে খুবই ভালো রেজাল্ট। আবার এই সেক্টরে যোগদান করার পর সকল শিক্ষককে সিইনএড, ডিপিএড ও বর্তমানে বিটিপিটিসহ বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করে আপডেট থাকতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে তবুও কেন কর্তৃপক্ষ তাদের ১০ম গ্রেড দিতে চায় না? কেন প্রধান শিক্ষক সরাসরি নন ক্যাডার থেকে নেওয়া হয়? এতে করে সহকারী শিক্ষকদেরকে পদোন্নতি দেওয়ার পথ কি রূদ্ধ হচ্ছে না? এটা কি তাদের সাথে বঞ্চনা করার সামিল নয়? একটা সাধারণ যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়, এই সেক্টরে লোকবল বেশি তাই ১০ম গ্রেডে বেতন দেওয়া হলে সরকারের কোষাগারে/খাজাঞ্চিতে টান পড়বে, অথচ অনেকেরই জানা নেই বর্তমানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকেরই বেতন বছরে বছরে ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হয়ে ১০ম গ্রেডের স্কেলেই চলে গেছে। ১০ম গ্রেড হলে সম্প্রতি যোগদানকৃত শিক্ষক ও নতুন যোগদানকৃত শিক্ষকেরাই আর্থিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। দেখা যায় সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদান করা হলে সর্বশেষ নিয়োগকৃত ২/৩ ব্যাচ শিক্ষকের বেতন কিছুটা বাড়বে, এছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকই ইতিমধ্যে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে ১০ম গ্রেডের স্কেলেই চলে গিয়েছেন। তাদের শুধু ১০ম গ্রেডের স্কেলের সাথে সমন্বয় সাধিত হবে। তন্মধ্যে ২০১৯ সালে যারা যোগদান করেছেন তাদের বর্তমান বেসিক বেতন হয়েছে ১৪০৫০/-, ২০২০ সালে নিয়োগকৃতদের বেসিক ১৩৩৮০/- ও ২০২৩ সালে নিয়োগকৃতদের বেসিক ১১৫৫০/- টাকা দাড়িয়েছে। অর্থাৎ উক্ত ৩ সালের নিয়োগকৃতদের বেতন বাঁড়বে যথাক্রমে ২০১৯ সালের ১৯৫০/-, ২০২০ সালের ২৬২০/- এবং ২০২৩ সালের নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বাড়বে ৪৪৫০/- টাকা। অর্থাৎ এই ৩ ব্যাচেরই কিছুটা বেশি বাড়বে অন্যদিকে এর আগের নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কারো ১০/-, কারো ২০/- বা ১০০/-, ২০০/- এভাবেই স্কেলের সাথে সমন্বয় হবে। অর্থাৎ যদি বলা হয় এত বিপুল পরিমান শিক্ষকদের বেতন দিতে সরকারের অনেক টাকার প্রয়োজন সেটা বলাও অযৌক্তিক। আসলে ১০ম গ্রেড প্রাপ্তি শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের আর্থিক সুবিধার জন্য নয় বরং তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যও দরকার।
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, এর কারণ কী?
শিক্ষকরা দাবী করছেন এতে শুধু মনিটরিংয়ের অভাব বললে হবে না। মূলত সরকারি প্রাথমিকের প্রায় ৯৯% স্কুলেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক নেই। যে অনুপাত হওয়ার কথা ১:২০ সেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত রয়েছে ১:৫০ অথবা তার চেয়েও বেশি। এছাড়াও শিক্ষক স্বল্পতার পাশাপাশি আছে শ্রেণিকক্ষের সংকট অর্থাৎ অবকাঠামোগত সমস্যা। যদিও তৎকালীন সরকার দিনে-রাতে উন্নয়নের তসবিহ পড়ত, কিন্তু প্রাথমিকে এমনও স্কুল আছে, যেখানে শিশু শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৯টি শ্রেণিতে পাঠদান কার্যক্রম চলমান আছে, অথচ পাঠদান উপযোগী শ্রেণিকক্ষ মাত্র ৩টি! আর ৯টি ক্লাসের জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ৪/৫/৬ জন! তাহলে এখানে আপনি কতটুকু উন্নতমানের পড়াশোনা প্রত্যাশা করতে পারেন? এরপরেও একটা কথা মাথায় রাখতে হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূলত ভর্তি হয় দেশের সর্বস্তরের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর এখানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক অনেকাংশই অসচেতন, যার জন্য সেইসকল অভিভাবকদের সন্তানরা পড়ালেখায় কতটুকু উন্নতি করতে পারছে বা তাদের কোথায় কোথায় দুর্বলতা রয়েছে সেদিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেন না। এছাড়াও বর্তমানের কোটাবর্জিত নিয়োগবিধি অনুযায়ী যদি নিয়োগ করা হয় তাহলে অনেক পুরুষ শিক্ষক প্রাইমারিতে আসবেন। তারাও শিক্ষার্থীদের সুন্দর পাঠদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য আরো উপযোগী করে তুলতে সহযোগী হবেন। পুরুষেরা আসলে তখন নারী শিক্ষক ও পুরুষ শিক্ষকদের মধ্যে একটা ভারসাম্য আসবে এই ডিপার্টমেন্টে। কারন অনেক প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাজ শুধুমাত্র নারীদের তুলনায় নারী ও পুরুষ শিক্ষকদের সমন্বয়ে সাধিত হলে সুন্দর ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুন বেড়ে যায়।
সহকারী শিক্ষকদের এন্ট্রিপদ ১০ম গ্রেড ধরে এবং উন্নীত স্কেলের সাথে উচ্চতর গ্রেডের মিল না করে বরং যোগদানের তারিখ থেকে উপরের সকল পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি, টাইম স্কেল/উচ্চতর গ্রেড বাস্তবায়ন করা, সারাবছর বদলী চালু রাখা, প্রতিটি বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ করা, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন/সংস্কার, নন ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা, প্রতিটি বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, সকল ভাতা বর্তমান বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্য করে যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করা, প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার চালু ও বিপিএসসি কর্তৃক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ-যোগদান-বদলী-পদোন্নতি দেওয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের নিকট এই পেশাকে আরো আকর্ষণীয় করাই হবে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা একজন শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে সততা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা এবং পরিশ্রমের মূল্যবোধ সৃষ্টি করাই একজন শিক্ষকের প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষক যখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকান, তখন তাদের কৌতূহল, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা শিক্ষককে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করে। শুধু শিশুদের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও আগ্রহের কারণেই শিক্ষকতা পেশার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
শিক্ষক হিসেবে তাদের কাজ শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান বিতরণই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো এবং নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া। এজন্য তাদের প্রয়োজন ধৈর্য, সহানুভূতি এবং সীমাহীন ভালোবাসা। আর এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
তবে মনে রাখতে হবে, যেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরেও আর্থিক এবং সম্মানের কারণে অন্য কোন পেশাতে যেতে চাইবে না, যেদিন একজন মেধাবী তরুণ-তরুণী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, সেদিনই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। আর এই পোস্ট ও জবকে তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় করার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে দেশকেই। কর্তৃপক্ষকেও আরো আন্তরিক, শিক্ষকভাবাপন্ন ও সহযোগী হতে হবে। তাহলেই মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা।
এন ইউ প্রিন্স
সহকারী শিক্ষক,
হাওলাদার ডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদরপুর, ফরিদপুর।