দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর অন্যতম বড় বাধা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হলেও, অভিযোগ রয়েছে যে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার দুর্নীতিবাজ দায়মুক্তি পেয়েছেন। এই ঘটনার ফলে নৈতিকতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসন নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং কীভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা এই প্রবন্ধে করা হবে।গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র
বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনা এবং সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা নিম্নরূপ:
(১) ২০০৮-২০১৪: ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ ও প্রশাসনিক দুর্নীতি
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, বাস্তবে দেখা যায়:
- দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর অন্যতম বড় বাধা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হলেও, অভিযোগ রয়েছে যে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার দুর্নীতিবাজ দায়মুক্তি পেয়েছেন। এই ঘটনার ফলে নৈতিকতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসন নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং কীভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা এই প্রবন্ধে করা হবে।দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্বলতা: প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা।
- শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি (২০১০): হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন, কিন্তু মূল অপরাধীরা বিচারের বাইরে থেকে যান।
- রেলওয়ে ও যোগাযোগ খাতে দুর্নীতি: তৎকালীন রেলমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
- পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ: বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে প্রকল্প থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে।
(২) ২০১৪-২০১৯: বৃহৎ প্রকল্প ও ব্যাংক খাতে দুর্নীতি
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে:
- ব্যাংক খাতে দুর্নীতি: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি (সুইফট হ্যাক) এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি।
- সরকারি প্রকল্পে ব্যয়ের অতিরিক্ততা: সেতু, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ খাতে প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি।
- রাজনৈতিক আশ্রয়ে দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি: দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
(৩) ২০১৯-২০২৪: ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচার
২০১৯ সালের পর দুর্নীতির আরও নতুন মাত্রা দেখা যায়।
- ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি: যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার বিস্তার।
- স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি: কোভিড-১৯ মহামারির সময় নিম্নমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় ও টিকা দুর্নীতি।
- অর্থ পাচার বৃদ্ধি: বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়, যা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরে আসে।
দুর্নীতির ধরণ ও প্রকৃতি
বাংলাদেশে দুর্নীতির ধরন বিভিন্ন হতে পারে। সাধারণত দেখা যায়:
- প্রশাসনিক দুর্নীতি: সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ গ্রহণ করে কিংবা অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে সম্পদ আহরণ করেন।
- রাজনৈতিক দুর্নীতি: রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সরকারি ফান্ডের অপব্যবহার, টেন্ডার দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নেন।
- বেসরকারি খাতের দুর্নীতি: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুষ দিয়ে অবৈধভাবে চুক্তি লাভ করে বা আইন লঙ্ঘন করে ব্যবসা পরিচালনা করে।
- ব্যাংকিং দুর্নীতি: ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার এবং ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করা হয়।
- বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি: কিছু ক্ষেত্রে আইনজীবী, বিচারক এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে দুর্নীতির সংযোগ থেকে অপরাধীরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়।
- শিক্ষা খাতে দুর্নীতি: ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন, অবৈধভাবে চাকরি প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়।
প্রায় ৩ হাজার দুর্নীতিবাজ কীভাবে দায়মুক্তি পেলেন, তা বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি কৌশল পরিলক্ষিত হয়:
- রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রতিরক্ষা: ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দুর্নীতির অভিযোগ থাকা ব্যক্তিদের আশ্রয় দিয়েছে।
- আইনি ফাঁকফোকর: দুর্বল তদন্ত, সাক্ষীর অনুপস্থিতি বা অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের ফলে দুর্নীতিবাজরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।
- ঘুষ ও প্রভাব বিস্তার: প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ঘুষের মাধ্যমে মামলাগুলি নিস্পত্তি করা হয়েছে।
- দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের আশ্রয়: উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা অপরাধীদের রক্ষা করে এবং মামলাগুলোর যথাযথ তদন্ত বাধাগ্রস্ত করেন।
- নৈতিক অবক্ষয়: জনগণের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে আইন কেবল দুর্বলদের জন্য, প্রভাবশালীদের জন্য নয়।
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগ কমে যায় এবং বৈদেশিক অনুদান বা ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
- প্রশাসনিক অকার্যকারিতা: দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা দায়মুক্তি পাওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
- রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়ার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন: দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা চালু করা, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে আইন বাস্তবায়ন করা যায়।
স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা।
দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা।
বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি বিরোধী চুক্তি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশে দুর্নীতির ধরন বিভিন্ন হতে পারে। সাধারণত দেখা যায়:
বিশেষ করে ইকবাল মাহমুদের সময়ে সবচেয়ে বেশি দায়মুক্তির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে।
দায়মুক্তির প্রক্রিয়া
প্রায় ৩ হাজার দুর্নীতিবাজ কীভাবে দায়মুক্তি পেলেন, তা বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি কৌশল পরিলক্ষিত হয়:
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থাটির উচ্চপদস্থরা সবসময় ক্ষমতার ছায়া অনুসরণ করেছেন এবং সরকারের ইচ্ছামতো কাজ করেছেন। ফলে দুর্নীতি দমন কার্যক্রম কার্যকর হয়নি।
১. নৈতিক অবক্ষয়: জনগণের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে আইন কেবল দুর্বলদের জন্য, প্রভাবশালীদের জন্য নয়। ২. অর্থনৈতিক ক্ষতি: দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগ কমে যায় এবং বৈদেশিক অনুদান বা ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ৩. প্রশাসনিক অকার্যকারিতা:দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা দায়মুক্তি পাওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ৪. রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়ার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৫. আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন: দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং বিচারহীনতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে নতুন সরকার আসার পর পরিস্থিতি বদলেছে। আগের অনেক ক্লিনচিট পাওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে আবার অনুসন্ধান ও মামলা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্ত জোরদার হয়েছে।
১. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন: বাংলাদেশ ক্রমাগত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২. বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ: দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। ৩. জাতিসংঘের উদ্বেগ: দুর্নীতির কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা বাড়ছে।
প্রায় তিন হাজার প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল
১. স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা। ২. দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা। ৩. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা। ৪. বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি বিরোধী চুক্তি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। ৫. নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা চালু করা, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে আইন বাস্তবায়ন করা যায়। ৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে জনগণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন ও দায়মুক্তি বন্ধ করতে হলে কার্যকর আইনি কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে প্রশাসন ও অর্থনীতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে কেবল তখনই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে।