বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পদক প্রদান এবং সেই সম্পর্কিত বিতর্কের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব ও পুলিশী আচরণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। গত কয়েক বছর ধরে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড, পদোন্নতি এবং পুরস্কারের ব্যাপারে সমালোচনা ও বিতর্ক উত্থিত হয়েছে, যা দেশজুড়ে পুলিশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং তাদের দক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এবারের পুলিশ সপ্তাহে পদক প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিতর্কিত নাম রয়েছে, যা পুলিশের কর্মপ্রবাহ, সরকারের প্রভাব, এবং রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে জড়িত।
মনিরুল হক ডাবলু: বিতর্কিত পদক প্রাপ্তি
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একজন কর্মকর্তা হলেন মনিরুল হক ডাবলু, যিনি কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং পুলিশ সপ্তাহে পদক পেয়েছেন। তার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কারণ তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুর কমিটির নির্বাহী সদস্য ছিলেন। এর ফলে তার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আনুগত্য এবং পুলিশের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র হিসেবে তার ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তবে সম্প্রতি তাকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় ওসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
মনিরুল হক ডাবলুর পদোন্নতির পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার দলীয় পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং তাকে পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে রাখা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যদিও তার দলীয় সম্পর্ক পুলিশের পেশাগত জীবনকে প্রভাবিত না করলেও, সাধারণ মানুষ এবং পুলিশ সদস্যদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
বিপ্লবী পুলিশ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা
পদক প্রাপ্তির তালিকায় এমন অনেক নাম রয়েছে, যারা পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে সরকারের একাধিক আদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির উদ্দিন। ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের সময়, নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে তিনি অপ্রত্যাশিত সাহসিকতা প্রদর্শন করে ভোট কেন্দ্র দখলে বাধা দিয়েছিলেন এবং স্থানীয় নেতাদের হুমকি সত্ত্বেও তা পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এই সাহসিকতার জন্য তাকে পদক দেওয়ার জন্য যোগ্য মনে করা হয়, কিন্তু তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বশির উদ্দিন তার অভ্যন্তরীণ বক্তব্যে বলেন, “আমি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি।”
এছাড়া, অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান, যিনি ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং সরকারের আদেশ অমান্য করার কারণে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, তার নামও পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় নেই। তিনি দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের মধ্যে সঠিক বিচার এবং জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে সরকার তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায়, তিনি এখনও পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি পাননি।
বিপ্লবী ভূমিকা পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা
এছাড়া, ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানের নামও পদকের তালিকায় নেই, যদিও তিনি বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছেন এবং স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। জিল্লুর রহমানের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল এবং একাধিক বার চাকরি হারানোর পরও আদালতের নির্দেশে ফিরে এসেছেন। তার এই বিদ্রোহী ভূমিকা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পুলিশ বাহিনীর নৈতিকতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার নাম পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় না থাকায় অনেক পুলিশ কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
পদক প্রদান ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব?
এবারের পদক প্রদান পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে এবং পুলিশের সত্যিকারের সেবা ও অবদানকে সম্মান জানাতে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি, এমনটাই মনে করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। অনেকের মতে, যারা ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে, জনগণের পক্ষে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন, তাদের নাম পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সেসব কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে যে কর্মকর্তাদের নির্বাচন করা হয়েছে, তারা অনেকটাই রাজনৈতিক আনুগত্যে পুরস্কৃত হয়েছেন।
এছাড়া, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাধারণ সদস্যদের চেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আধিপত্যও দৃশ্যমান। পদক তালিকায় ২১ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছে, যা পুলিশের অভ্যন্তরীণ নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। যদিও পদক প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও রয়েছে যারা কর্মদক্ষতা ও সেবার জন্য এই পদক পেয়েছেন, তবুও পুলিশের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর প্রভাব
বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে এ ধরনের বিতর্কিত পদক প্রদান ব্যবস্থা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পুলিশের কার্যক্ষমতার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। পুলিশের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি তাদের পেশাগত কর্মকাণ্ডে পক্ষপাতিত্ব এবং নিরপেক্ষতার অভাব দেখা দিতে পারে। এর ফলে সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের মর্যাদা কমে যেতে পারে এবং জনগণের বিশ্বাস হ্রাস পেতে পারে। পুলিশ বাহিনীর স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এমন একটি সংস্কার প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত এবং নিরপেক্ষ থাকবে।
এছাড়া, এই বিতর্কের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই ধরনের পদক প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন, বিশেষ করে যখন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখেননি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর স্বাধীনতা এবং পক্ষপাতিত্ব মুক্ত কাজের জন্য নানা রকমের পরামর্শ এসেছে, যাতে জনগণের বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়।
এভাবে, পুলিশ বাহিনীতে পদক প্রদান এবং বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পদক দেওয়ার মধ্যে যে অসঙ্গতি বিদ্যমান, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং পুলিশ বাহিনীর স্বাধীনতার প্রশ্নে আরো বড় আকারে আলোচনার সৃষ্টি করতে পারে। দেশজুড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যে আস্থাহীনতা এবং ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা সমাধান করতে হলে এই ধরনের পক্ষপাতিত্বমূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য এটি একটি সময়োপযোগী সংকেত, যে তারা যদি জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি রাখতে চায়, তাহলে তাদের কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।