সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও তার বলদর্পী (bully) কৌশল অবলম্বন করছেন, এবার লক্ষ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি ইউক্রেন সংকট সমাধানে নিজের শর্তে একটি চুক্তি করতে চান এবং এজন্য জেলেনস্কিকে “স্বাভাবিক আচরণ” করতে হবে।
বিশ্ব রাজনীতিতে এই মন্তব্য নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের সমর্থকরা মনে করছেন, তার কঠোর নেতৃত্ব যুদ্ধ বন্ধ করতে সহায়ক হবে, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে শক্তিশালী করতে পারে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
ট্রাম্পের বক্তব্য ও কৌশল
ট্রাম্প সবসময় দাবি করে আসছেন যে, যদি তিনি ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হবেন। তবে কীভাবে তা করবেন, সে বিষয়ে তিনি কখনোই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি।
সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে তিনি বলেন, "জেলেনস্কিকে কিছুটা নমনীয় হতে হবে, শান্ত থাকতে হবে এবং আমার দেওয়া চুক্তি মেনে নিতে হবে।"
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প মূলত জেলেনস্কিকে চাপে ফেলে শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে চাইছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে শক্ত অবস্থানে রেখেছে এবং এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ভালো নয়।
ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি অপচয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এত ব্যয় করা উচিত নয়।
ট্রাম্পের চুক্তির সম্ভাব্য শর্তাবলী
ট্রাম্পের “আমার চুক্তি মেনে নাও” বক্তব্যের পেছনে কী ধরনের পরিকল্পনা থাকতে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। সম্ভাব্য কয়েকটি দিক হলো:

- ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ড রাশিয়াকে ছেড়ে দেওয়া:
ট্রাম্প বারবার বলেছেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মূল সমস্যা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তিনি ইউক্রেনকে কিছু অংশ ছেড়ে দিতে চাপ দিতে পারেন, বিশেষ করে দোনবাস ও ক্রিমিয়ার মতো অঞ্চলগুলো, যেগুলো রাশিয়া ইতিমধ্যে দখল করেছে। - যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা কমানো:
ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তিনি ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সামরিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারেন। এটি ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিচালনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এবং দেশটিকে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে। - ন্যাটোর অবস্থান পরিবর্তন:
ট্রাম্প অতীতে বলেছেন যে, ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের জন্য যা করছে, যুক্তরাষ্ট্রেরও তা করা উচিত নয়। তিনি ন্যাটোর প্রতি বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েও ন্যাটোর ব্যয়ের চাপ কমানোর জন্য ইউরোপের দেশগুলোকে হুমকি দিয়েছিলেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বরাবরই ট্রাম্পের এই ধরনের মনোভাবের বিরোধিতা করেছেন। তিনি মনে করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের পূর্ণ সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ।

জেলেনস্কি একাধিকবার বলেছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তি হতে হবে আন্তর্জাতিক আইন এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, ইউক্রেন কখনোই তাদের ভূখণ্ডের এক ইঞ্চি অংশও রাশিয়াকে ছেড়ে দেবে না।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের মাটি রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। আমাদের জনগণের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না।”
জেলেনস্কির সরকার মনে করে, যদি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন এবং ইউক্রেনকে সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে ইউক্রেনকে বিকল্প কৌশল নিতে হবে। এর মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর আরও নির্ভরশীল হওয়া এবং নিজেদের সামরিক সক্ষমতা আরও বাড়ানো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য শুধুমাত্র ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তার অবস্থান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বর্তমান নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা ট্রাম্পের ভাষায় “অপ্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল”।
- ন্যাটো ও ইউরোপীয় নেতাদের উদ্বেগ:
ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ তিনি পুনরায় ক্ষমতায় এলে ন্যাটোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন, যাতে তারা ইউক্রেনের জন্য আরও বেশি দায়িত্ব নেয়। - পুতিনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া:
ট্রাম্পের অবস্থান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে সহায়তা কমান, তবে পুতিন আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন এবং ইউক্রেনের অধিক ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করতে পারেন। - যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া:
মার্কিন রাজনীতিতেও এই ইস্যু বড় বিতর্ক তৈরি করেছে। রিপাবলিকান পার্টির অনেক সদস্য ট্রাম্পের অবস্থান সমর্থন করলেও, কিছু রিপাবলিকান এবং বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট মনে করেন যে, ইউক্রেনকে সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্পের ‘বুলি’ কৌশল জেলেনস্কির মতো নেতার জন্য সহজেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইউক্রেন এখনো তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, এবং ট্রাম্পের কথিত ‘ডিল’ কী হতে পারে, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
যদি ট্রাম্প ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, তবে ইউক্রেন সংকটের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত মোড় নিতে পারে। ট্রাম্প যদি তার নীতির মাধ্যমে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে একটি আপস করতে বাধ্য করেন, তবে সেটি ইউরোপের নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমানে, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল, এবং পশ্চিমা মিত্রদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হন, তবে এই ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ কতটা বদলে যাবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।