সদরুল আইনঃ
ঋণের কিস্তি ছাড়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধিদল।
দুই সপ্তাহ পর্যালোচনা করার পরেও সংস্থাটি বলছে আরো আলোচনা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আইএমএফ আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এ ব্রিফিংয়ে আইএমএফের মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওসহ অন্য ৯ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাংলাদেশ ও এর জনগণের পাশে থাকার জন্য আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি। ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আরো আলোচনা হবে।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বহিঃস্থ অর্থায়নের ঘাটতি মোকাবিলা এবং চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি নীতিগত কড়াকড়ি আরোপে অপরিহার্য বলে মনে করে আইএমএফ।
উল্লেখ্য, এর আগেও কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আইএমএফ মিশন ঢাকায় এসেছিল। তখন মিশন শেষে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ‘স্টাফ লেবেল এগ্রিমেন্ট’ বা চুক্তি হয়েছিল। এটি মূলত কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর পর সংস্থাটির বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু এবার এ ধরনের স্টাফ লেবেল চুক্তি হয়নি বলে জানা গেছে। এবার সফর শেষে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে পাপাজর্জিও বলেন, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখনো একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে তা ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
গণঅভ্যুত্থান, কঠোর নীতিগত সমন্বয় এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তার কারণে এই মন্থরতা দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌছানোর পর তা ২০২৫ সালের মার্চে কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে। যদিও এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ৫-৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার অনেক উপরে রয়েছে।
পাপাজর্জিও বলেন, সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত বিনিয়োগে সহায়তার জন্য রাজস্ব আয়ে উন্নয়ন এবং ব্যয় সংস্কারে একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত দীর্ঘদিন ধরে কম থাকায় একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল কর ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে, কর ছাড় কমবে, কমপ্লায়েন্স বাড়বে এবং করনীতি প্রশাসন থেকে পৃথক করা যাবে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সুসংগঠিত ও বিস্তৃত আর্থিক খাত সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আইনি সংস্কার জরুরি এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে একটি কার্যকর কাঠামো বাস্তবায়ন করা দরকার যা একদিকে ছোট আমানতকারীদের সুরক্ষা দেবে, অন্যদিকে সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাংক পুনর্গঠন সম্ভব করবে।
তিনি জানান, কার্যকর অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি জোরদার করবে। পাশাপাশি, আর্থিক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এর সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে উন্নত সুশাসন ও স্বচ্ছতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক খাত সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও শাসনব্যবস্থা জোরদারে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাঠামোগত সংস্কারের গতি ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
তাদের মতে, সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য আরো অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধির পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য খাতে রপ্তানি সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।
আইএমএফের মতে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে (এএমএল/সিএফটি) ঝুঁকি মূল্যায়নে অগ্রগতি এবং তথ্যের মানোন্নয়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামষ্টিক অর্থনীতি ও রাজস্ব খাতে ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি অপরিহার্য বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
আইএমএফ জানিয়েছে, চলতি এপ্রিলে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন সভাকে সামনে রেখে স্টাফ লেভেলে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আলোচনা চলছে, যার মাধ্যমে তৃতীয় ও চতুর্থ কর্মসূচি পর্যালোচনার পথ সুগম হবে।
তবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য অংশীদারদের আন্তরিক আতিথেয়তা এবং খোলামেলা আলোচনার জন্য আইএমএফ দল কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে। এবারের সফরকালে আইএমএফ প্রতিনিধিদল অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে।
তারা বেসরকারি খাত, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছে।