স্টাফ রিপোর্টার :
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানায় করা একটি হত্যা মামলায় ‘মৃত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ময়মনসিংহের সুলাইমান সেলিমকে—যিনি এখনো জীবিত এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর ওই এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে, আর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে: হত্যা মামলা নিয়ে কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসা চলছে?
বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সেলিমের বড় ভাই মোস্তফা কামাল ৩১ আগস্ট ২০২৪ সালে যাত্রাবাড়ি থানায় মামলাটি করেন, যেখানে সেলিমকে ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত দেখানো হয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার পুলিশ তার ঠিকানা যাচাই করতে গিয়ে সেলিম নিজেই জানতে পারেন, তাকে মৃত দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে।
সেলিম বলেন, “ভিতরে অনেক কষ্ট… আমি জীবিত থাকতে আমাকে মৃত বানানো হয়েছে। আমার বড় ভাই সরকারের কাছে প্রমাণ দিয়েছেন আমি মারা গেছি। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।”
ভুক্তভোগী আরও জানান, ‘‘৪ বার যাত্রাবাড়ি থানা আর ১ বার ডিবি অফিসে গিয়ে হাজিরা দিয়েছি নিজেকে প্রমাণ করতে। যদি এই মধ্যেই আমাকে কেউ মেরে ফেলত, তাহলে আমি হয়ত ‘সরকারি লাশ’ হয়ে যেতাম।’’
তদন্তের অগ্রগতি ও রহস্যময় বাদী
জানা গেছে, মামলার বাদী মোস্তফা কামাল এখন পলাতক। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা সেলিমের পরিচয় যাচাইয়ে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের নির্দেশও পেয়েছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—নিজ ভাই কেন তাকে হত্যা মামলার ‘মৃত’ বলে উল্লেখ করবেন?
ফুলবাড়িয়ার ধামর এলাকায় বিষয়টি জানাজানি হতেই জনমনে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা পারিবারিক শত্রুতার বলি হতে পারেন সেলিম।
অভিযোগ গুরুতর, আসামির তালিকায় রাষ্ট্রপ্রধান!
উক্ত মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শেখ হাসিনাকে। আরও রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ মোট ৪১ জনের নাম। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ২০০ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে।
মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে মামলা করা কল্পনার বাইরে। এটি শহীদদের স্মৃতিকে অপমান এবং একটি গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশও হতে পারে।” তিনি আরও যোগ করেন, “সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, এমনকি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে—এটা অরাজনৈতিক হয়রানিরই লক্ষণ।”
আইনজীবী এলিনা খান বলেন, “এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে জড়ানো হলে তা শুধু ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, ভবিষ্যতে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলবে।” তিনি বলেন, “এমন ঘটনা রোধে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা চায় জনতা
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, মৃত্যুর ঘটনায় প্রায় ১৫০০ মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদরদপ্তরের সূত্র জানায়। এর মধ্যে প্রায় ৬০০টিই হত্যা মামলা। কিন্তু এসব মামলায় যদি নিরপরাধ, এমনকি জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে জড়ানো হয়, তাহলে তা প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেও ব্যবহার হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব মামলার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি বা টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন, যাতে ন্যায়বিচার ও নির্দোষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।