ভারতীয় উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দিল্লির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্থান পায়নি, যা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
🔹 মোদি কেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুললেন?
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নীতি ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
✅ প্রধান উদ্বেগের কারণ:
- রাজনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, যা ভারতের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- চীনের প্রভাব: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বেড়েছে, যা ভারতীয় কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য উদ্বেগজনক।
- রোহিঙ্গা সংকট: ভারত মনে করছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি: ভারত চায় বাংলাদেশে এমন সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, যা তাদের আঞ্চলিক নীতি ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে এলে তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দিল্লিতে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদি চাইছিলেন ট্রাম্প বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিষয়ে শক্ত কোনো অবস্থান নিন এবং ভারতের উদ্বেগকে আমলে নিয়ে যৌথ বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করুন। কিন্তু সেটি হয়নি।
🔹 ট্রাম্প কেন নীরব থাকলেন?
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের মূল লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রাম্প কৌশলগতভাবে সেই ইস্যুতে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।
✅ সম্ভাব্য কারণ:

- যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকার: ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে চীন ও রাশিয়া প্রতিরোধ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশ এই বৃহৎ কৌশলগত ইস্যুতে বিশেষ স্থান পায়নি।
- ভারত-মার্কিন স্বার্থের পার্থক্য: ভারত চায় বাংলাদেশ তার প্রভাব বলয়ে থাকুক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণ করুক।
- বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ: বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চায় সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকুক, কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
🔹 যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ না আসার কারণ
বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীর, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মতো ইস্যুগুলো গুরুত্ব পেলেও বাংলাদেশের প্রসঙ্গ অনুপস্থিত ছিল। এটি ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের বাস্তবতা ও পার্থক্যকে প্রকাশ করে।
✅ বিশ্লেষকরা বলছেন:
- যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চায় না: ট্রাম্প প্রশাসন চায় বাংলাদেশ তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাধান খুঁজে নিক।
- ভারতের অনুরোধের সীমাবদ্ধতা: মোদি বাংলাদেশের ইস্যু উত্থাপন করলেও এটিকে যৌথ বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করেননি।
- বাণিজ্য ও সামরিক চুক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ: ভারত-মার্কিন আলোচনায় মূলত প্রতিরক্ষা চুক্তি ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের দিকগুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
🔹 ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সমীকরণ
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের পার্থক্য ভবিষ্যতে আরও স্পষ্ট হতে পারে।
✅ ভারতের অবস্থান:
ভারত চায় বাংলাদেশ তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে থাকুক এবং চীনের প্রভাব কম থাকুক।
✅ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান:
যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তার কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখুক।
✅ বাংলাদেশের করণীয়:
বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
শেষ কথা
মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনা করলেও যৌথ বিবৃতিতে এটি স্থান না পাওয়া স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটন এখনো বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রকাশ্যে কোনো শক্ত অবস্থান নিতে চায় না। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন বা বড় কোনো ঘটনা ঘটলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হতে পারে।
বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে, যেখানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অন্যান্য শক্তিগুলোর প্রভাবের লড়াই চলতে থাকবে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখে।