আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালীকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ছে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই সংকীর্ণ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন বিশ্ববাজারে পরিবাহিত হয় প্রায় ২০ শতাংশ তেল। ফলে, হরমুজ এখন আর শুধু একটি সামুদ্রিক পথ নয়—এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং শক্তির ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দু।
প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া এই প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য ব্যবহারযোগ্য পথ রয়েছে মাত্র ১০ কিলোমিটার। ইরান, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘেঁষা এই জলপথ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো—সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন এবং ইউএই—তাদের অপরিশোধিত তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) পাঠায় বিশ্ববাজারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালীর উপর যে কোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ বা অবরোধ বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দামে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। ইতোমধ্যে ইরান একাধিকবার হুমকি দিয়েছে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হলে তারা এই প্রণালী বন্ধ করে দেবে। ২০১৯ সালে ইরান কর্তৃক ব্রিটিশ ট্যাঙ্কার আটক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন এই উত্তেজনার বাস্তব প্রমাণ।
প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাহরাইনভিত্তিক পঞ্চম নৌবহর মোতায়েন রেখেছে। অপরদিকে, ইরানও তাদের উপকূলজুড়ে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং নিয়মিত নৌ-মহড়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জোরদার করছে। এই পরিস্থিতিতে হরমুজ হয়ে উঠেছে এক ‘চাপ-সংবেদনশীল এলাকা’, যেখানে সামান্য উত্তেজনাই বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতিতে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে চীন ও ভারতও এ অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। চীন ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং ভারত চাবাহার বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে প্রণালী-সংলগ্ন এলাকায় প্রবেশাধিকার বাড়াচ্ছে।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা হরমুজ প্রণালীকে ‘আন্তর্জাতিক জলপথ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এর নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোপুরি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর হাতে। নিরাপত্তা ছাড়াও পরিবেশগত ঝুঁকিও রয়েছে এখানে। প্রতিদিন শতাধিক ট্যাঙ্কার চলাচলের কারণে সামান্য দুর্ঘটনাও মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কারণ হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সমুদ্রজীব ও উপকূলীয় অঞ্চলে।
বিশ্ব এখনো জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল, এবং হরমুজ প্রণালী সেই প্রবাহের একটি অপরিহার্য শিরা। তাই এই জলপথ ঘিরে যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত বা কৌশলগত পদক্ষেপই পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংগৃহীত: মোশাররফ হোসাইন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া