ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে। সম্প্রতি পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক ইউরোপের জন্য উন্নত সামরিক সক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, ইউরোপকে পারমাণবিক ও আধুনিক অপ্রচলিত অস্ত্র অর্জনের দিকেও নজর দিতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা কাঠামোর মাধ্যমে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন মনোভাব ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বর্তমানে ইউরোপে মাত্র দুটি দেশ—যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স—পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। এই দেশদুটির পারমাণবিক কর্মসূচি স্বাধীন হলেও, যুক্তরাজ্যের অস্ত্র ব্যবস্থার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।
ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এবং তারা অতীতেও ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিজেদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে এখন পর্যন্ত তারা ন্যাটোর পারমাণবিক নীতিতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেনি।
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক সম্প্রতি পার্লামেন্টে বক্তব্য প্রদানকালে বলেছেন,
“পোল্যান্ডকে সর্বোচ্চ উন্নত সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে আমরা যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে পারি।”
এটি মূলত ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পোল্যান্ড পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকেও নজর দিতে পারে। যদিও দেশটি বর্তমানে ন্যাটোর পারমাণবিক ভাগাভাগি কর্মসূচির (Nuclear Sharing Program) অংশ নয়, তবে তারা ভবিষ্যতে এই কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের কোনো নতুন দেশ যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে চায়, তবে তা খুব সহজ কাজ হবে না।
১. প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ:
- ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা গবেষণাগার স্থাপন করেনি।
- শুধুমাত্র যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশগুলোর কিছু নির্দিষ্ট গবেষণাগার রয়েছে যেখানে পারমাণবিক গবেষণা করা হয়।
২. আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাধ্যবাধকতা:
- ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির (Nuclear Non-Proliferation Treaty – NPT) সদস্য।
- নতুন কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হতে পারে।
৩. রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ:
- ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) অনেক দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের বিপক্ষে।
- পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করলে দেশীয় রাজনীতিতেও ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
জার্মানির সম্ভাব্য ভূমিকা
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইউরোপের অন্য কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটে, তবে জার্মানিই হতে পারে সেই দেশ।
প্রধান কারণসমূহ:
- জার্মানির রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি এবং সমৃদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র।
- দেশটিতে উচ্চমানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ হওয়ায় তারা পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে কৌশলগত সুবিধা পেতে পারে।
তবে রাজনৈতিক ও নৈতিক কারণে জার্মানি এতদিন পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা
রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক এবং তারা ইউক্রেন যুদ্ধের সময় একাধিকবার পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো এই হুমকিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে।
অন্যদিকে চীন তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করছে, যা ইউরোপের সামরিক বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির আলোচনা নতুন করে তীব্র হয়েছে। যদিও প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তবুও ভবিষ্যতে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটতে পারে।
তবে এই বিষয়টি ইউরোপীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এখন সময়ই বলে দেবে, ইউরোপ কি সত্যিই পারমাণবিক শক্তির দিকেই এগিয়ে যাবে, নাকি তারা ঐতিহ্যগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করবে।