আজ ২৮ জুন, দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের জন্মদিন। এ বছর তিনি ৮৫ বছরে পা রাখলেন। সংগীত ও সংস্কৃতির এই জীবন্ত কিংবদন্তি জীবনকে দেখেন একেবারে নতুন এক উপলব্ধি থেকে—যেখানে প্রতিটি দিনই তাঁর কাছে “আল্লাহর দেওয়া বোনাস”।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে নিজের জন্মদিন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফেরদৌসী রহমান বলেন, “আমার মা বেঁচে ছিলেন ৯০ বছর। ফুফু আম্মা ৯৪ বছরের বেশি। আমি ভাবতাম, আমার বয়স হয়তো ৬০-৭০ হবে। কিন্তু কীভাবে যে এতটা বেলা হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। এবার আমি ৮৫ বছরে পা দেব।”
১৯৪১ সালে ভারতের কোচবিহারে জন্ম নেওয়া ফেরদৌসী রহমান শৈশব থেকেই বেড়ে উঠেছেন সংগীতের আবহে। তিনি কিংবদন্তি পল্লীগীতি শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কন্যা। তাঁর শৈশব কেটেছে গানের নিকটবর্তী এক পরিবেশে। তাই সংগীত যেন তাঁর শিরা-উপশিরায় মিশে গেছে।
জন্মদিন নিয়ে ফেরদৌসী রহমানের নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। ছোটবেলায় তাঁর জন্মদিন তেমনভাবে উদ্যাপিত হতো না। তবে বড় ভাই মোস্তফা কামাল—সাবেক প্রধান বিচারপতি—তার জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হতো। সে সময় গান, কবিতা, আর খাওয়াদাওয়ার আড্ডায় মুখর হয়ে উঠত পরিবার। ফেরদৌসী রহমানের নিজের জন্মদিন প্রথম উদ্যাপন হয় ১৯৫৬ সালে, যেদিন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে সারা দেশে প্রথম হন। ২৬ জুন ফলাফল প্রকাশিত হয়, আর ২৮ জুন ছিল তাঁর জন্মদিন।
তবে এবারের জন্মদিনটি ভিন্নরকম। গত এক বছরে তিনি হারিয়েছেন জীবনের তিনজন প্রিয় মানুষকে—স্বামী রেজাউর রহমান, সংগীতজ্ঞ ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী এবং ভাইয়ের স্ত্রী আসমা আব্বাসী। ফেরদৌসী রহমান বলেন, “আমার স্বামী খুবই ইন্ট্রোভার্ট ছিলেন। জন্মদিনে কিছু না বলেই নীরবে নানা আয়োজন করতেন। আর ভাই-ভাবি যত ব্যস্তই থাকতেন না কেন, কেক আর ফুল নিয়ে আমার বাসায় চলে আসতেন। এবার তাঁরা কেউই নেই। খুব মন খারাপ হয়। আজ বিকেলে বসে বসে তাই ভাবছিলাম—জীবন এভাবেই পার হয়ে যায়।”
জীবনের এই দীর্ঘ পথচলায় ফেরদৌসী রহমান কৃতজ্ঞ ও তৃপ্ত। তিনি বলেন, “আশির পর এখন প্রতিটি দিন আল্লাহর কাছে বোনাস মনে হয়। আমাদের দেশে একটা সময় গড় আয়ু কতই বা ছিল? আগে তো ৫০-৬০ হলেই মানুষ বুড়ো হয়ে যেত। আমার আব্বা মারা গেছেন ৫৯ বছর বয়সে। সেই তুলনায় আমি ৬৯, ৭৯ পেরিয়ে এখন ৮৫-তে পড়লাম। আব্বার চেয়ে প্রায় ২৫ বছর বেশি জীবন পেলাম।”

জীবনকে ঘিরে তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারা আজও উজ্জ্বল। তিনি বলেন, “যদি কেউ জীবনকে সুখ হিসেবে দেখে, তাহলে সেটাই উদ্যাপন। আর যদি কেউ মনে করে জীবন হলো শাস্তি, তবে সেটাও তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কাছে জীবন সুখ-দুঃখের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা। ভালো-মন্দ মিলেই জীবন। কারও জীবনে ভালোটা একটু বেশি, আবার কারও জীবনে খারাপটা একটু কম। এটাই স্বাভাবিক।”
সংগীতের এই মহান সাধিকা আজও জীবনের প্রতিটি দিনকে দেখেন কৃতজ্ঞ চোখে। তাঁর জীবনদর্শন, স্মৃতিচারণা আর শিল্পভিত্তিক অভিজ্ঞতা আগামী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য শিক্ষার উৎস। জন্মদিনে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।