সত্যজিৎ দাস:
” ২ মে” দিনটি শুধু একজন মানুষ নয়,এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্মদিন। ১৯২১ সালের এই দিনে কলকাতায় জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়—উপমহাদেশের গর্ব,বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহীরুহ, বহুমাত্রিক প্রতিভার বিস্ময়কর রূপ।
তাঁকে শুধু একজন চলচ্চিত্রকার বললে অসম্পূর্ণ বলা হয়। কারণ তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা,চিত্রশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক,লেখক ও সম্পাদনা বিশেষজ্ঞ। শিল্পের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে,প্রতিটি কাজেই তিনি যুক্ত করতেন নিজের হাতে আঁকা রেখাচিত্র,গানের সুর, এমনকি নিজস্ব টাইপফেসও। তাঁর তৈরি রে-রোমান, রে-বিজারসহ কিছু ফন্ট এখনও শিল্প ও বিজ্ঞাপনের জগতে অনন্য।
চলচ্চিত্রে সত্যজিতের পদচারণা শুরু হয় এমন এক সময়ে,যখন বাংলা সিনেমা আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটাই অপরিচিত। অথচ ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিলেন—বাংলার এক গ্রাম্য ছেলের গল্পই হতে পারে বিশ্ব সিনেমার শ্রেষ্ঠ নির্মাণের উদাহরণ। এ সিনেমা তৈরিতে তাঁর লেগেছিল প্রায় পাঁচ বছর। কিন্তু অপেক্ষা বৃথা যায়নি। কান,বার্লিন,ভেনিস—বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসার ঝড় ওঠে।
প্রথমদিকের কয়েকটি ছবির বাদে সত্যজিৎ রায় নিজেই তাঁর অধিকাংশ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সুরের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তৈরি করেন এক অনন্য সাউন্ডস্কেপ, যা আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতে,চার্লি চ্যাপলিন ও সত্যজিৎ রায়—এই দুই চলচ্চিত্রকারই সঙ্গীতের উপর নিখুঁত দখল রাখতেন।
ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়ো—তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রগুলো শুধু কিশোর সাহিত্য নয়, আজ বাঙালির চিন্তার জগতে অবিচ্ছেদ্য নাম। লেখার স্কেচগুলোও ছিল তাঁর নিজের আঁকা। ক্যামেরার মতো লেখার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনা, নির্মাণের মুন্সিয়ানা।
শিল্পকলার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে। নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারীর মতো গুরুদের কাছ থেকে শিখেছিলেন চিত্রকলার সূক্ষ্মতা। ১৯৬১ সালে পারিবারিক পত্রিকা *সন্দেশ* পুনরায় চালু করে শিশুসাহিত্যের ভুবনেও তিনি যোগ করেন স্বকীয় স্বাক্ষর।
পরিবারের ডাকনাম ‘মাণিক’। তবে সময় প্রমাণ করেছে,এই ‘মাণিক’ শুধুই পরিবারের নয়—সেই মাণিক হয়ে উঠেছে বাংলা সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন। তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর, বাবা সুকুমার রায়—এই সাহিত্যিক উত্তরাধিকারকে সম্মান জানিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক শক্তিশালী শিল্পপরিবারের ধারাবাহিকতা।
সত্যজিৎ রায় শুধুমাত্র একজন মানুষ নন,তিনি একটি দর্শন। তাঁর সিনেমা,তাঁর লেখা,তাঁর চিত্রনির্মাণ—সবকিছু মিলে তিনি প্রমাণ করে গেছেন,বাংলা শুধু সাহিত্যে নয়,চলচ্চিত্রেও বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।
আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা কেবল শ্রদ্ধা নিবেদন করি না—তাঁর মতো করে ভাবতে শিখি,সৃষ্টি করতে শিখি,মানুষের গভীর গল্পগুলো তুলে ধরতে শিখি। কারণ সত্যজিতের ভাষায়- “যতক্ষণ মানুষ আছে, ততক্ষণ মানুষের গল্প থাকবে।”