ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত টঙ্গী সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফাহমিন জাফরের শেষ ইচ্ছা ছিল, ‘স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে গিয়ে আমার মৃত্যু হলে খুনি হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আমার লাশ ঘরে আনবে না।’ এই কথা কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছেন তার মা শিল্পী বানু।
ঘটনার বিবরণ:
২৪ জুলাই ২০২৫, ঢাকার উত্তরা এলাকায় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন ফাহমিন জাফর। তাকে উত্তরের ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পুলিশের গুলিতে তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ফাহমিন জাফর নওগাঁর আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বুয়েটে পড়াশোনা করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি ঢাকায় মামার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন।
মায়ের বেদনাদায়ক স্মৃতি:
ফাহমিনের মা শিল্পী বানু বলেন, ‘জাফরের জন্ম হয়েছিল ১০ জুলাই ২০০৬ সালে। সেই জুলাই মাসেই আমার বুকের মানিককে আমার কোল খালি করে রক্তপিপাসা নিবৃত্ত করেছে খুনি হাসিনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাফরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর সদস্যরা আমাকে পদে-পদে বাধা দেয় এবং অশালীন আচরণ করে।’
হাসপাতালে পৌঁছে তিনি দেখেন, তার ছেলে ফাহমিন আর নেই। হাসপাতালের একজন চিকিৎসক তাকে দ্রুত লাশ নিয়ে যেতে বলেন, ‘দেরি করলে পুলিশ আপনার ছেলের লাশ গায়েব করে দিতে পারে।’
পরিবারের প্রতিক্রিয়া:
ফাহমিনের বাবা শেখ আবু জাফর বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিল ফাহমিন। ১৮ জুলাই ছেলের সাথে সকাল ১০টায় মোবাইল ফোনে শেষ কথা হয়।’ তিনি জানান, ফাহমিন তাকে বলেছিল, ‘আন্দোলনে আছি।’ বাবা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসতে বলেছিলেন। ফিরল ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।
ফাহমিনের চাচি সাথি বেগম ও চাচা শেখ মসির উদ্দীন বলেন, ‘জাফরকে গ্রামের ছোট-বড় সবাই ভালোবাসত। সে ছিল শান্ত প্রকৃতির। মেধাবী জাফরের লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছা ছিল।’
শেষকৃত্য ও দাবি:
১৯ জুলাই শুক্রবার বাদ জুমা ফাহমিন জাফরের লাশ তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাইয়ের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। গ্রামবাসী শহীদ জাফরের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি তার খুনিদের বিচার দাবি করেন।
ফাহমিন জাফরের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য একটি বড় ক্ষতি। তার আত্মত্যাগ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নতুন প্রেরণা যুগিয়েছে। ফাহমিনের মতো শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি আজও জোরালো। ফাহমিনের পরিবার ও দেশবাসী তার হত্যাকারীদের বিচার এবং শেখ হাসিনার পতন চান। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সচেতনতা ও সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা।