বাংলাদেশের আকাশপথে বাণিজ্যিক কার্গো পরিবহনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা প্রতিবছর গড়ে ২,১০,০০০ মেট্রিক টন রপ্তানি ও ১,২১,০০০ মেট্রিক টন আমদানি সামগ্রী পরিবহন করে থাকে। তবে দেশের অন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো—যেমন চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর বা সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর—এই দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। এরই মধ্যে ভারত আকস্মিকভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যান। কিন্তু এই সংকটকেই সুযোগে পরিণত করে এগিয়ে আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এবং রপ্তানিকারকদের সম্মিলিত চেষ্টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে নতুন করে গড়ে তোলা হয় কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার উপযোগী করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের RA3 সার্টিফিকেশন লাভ করে সিলেট বিমানবন্দর, যার কার্যকারিতা ২০২৮ সাল পর্যন্ত থাকবে। এই সার্টিফিকেশন প্রাপ্তির পর ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল সিলেট থেকে স্পেনের জারাগোজা গন্তব্যে প্রথম ফ্রেইটার ফ্লাইট আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এরপর মে মাসজুড়ে সপ্তাহে ১টি করে ফ্লাইট পরিচালিত হয়, আর জুন থেকে শুরু হচ্ছে সপ্তাহে ২টি করে নির্ধারিত কার্গো ফ্লাইট। শিগগিরই সপ্তাহে অন্তত চারটি ফ্রেইটার পরিচালনার প্রস্তুতি রয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও নিয়মিত কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিমান। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। একই সময়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নতুন সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠছে কক্সবাজার বিমানবন্দর, যেটি সম্প্রসারিত রানওয়ে ও উন্নত অবকাঠামোর মাধ্যমে এখন চতুর্থ বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মর্যাদা পেয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগের সুবিধা এবং চট্টগ্রাম থেকে স্বল্প দূরত্ব—এই দুটি বিষয় মিলিয়ে কক্সবাজার এখন অল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে কার্গো পরিবহনের সম্ভাবনাময় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এখানে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য জনবল, ওয়্যারহাউজ ও যন্ত্রপাতি প্রস্তুতের কাজও এগিয়ে নিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
এদিকে ঢাকায় নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধনের অপেক্ষা চলছে, যা চালু হলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো পরিচালন ক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। যেখানে ২০১৯ সালে মোট কার্গো পরিবহন ছিল প্রায় ৩.৩৪ লক্ষ মেট্রিক টন, সেটি ২০২৫ সালে ৪.৩৪ লক্ষ এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ৬.৬৩ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দূরদৃষ্টি ও সক্রিয় ভূমিকা। নতুন টার্মিনালের জন্য সংযোজন করা হচ্ছে ৩৩৫টি হাইড্রোলিক হ্যান্ড ট্রলি, ৮টি টো ট্রাক্টর, ১৮টি মিনি ফর্ক লিফট, ১৪টি বড় ফর্ক লিফট এবং ৬টি লাগেজ বাগি সহ মোট ৩৮১টি আধুনিক হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিমান কার্গো বিভাগ অর্জন করেছে রেকর্ড পরিমাণ আয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ RA3 এবং ACC3 সার্টিফিকেশন অর্জন করে বিমান তার আন্তর্জাতিক মান ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিশ্বের ৪৮টি শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের কার্গো হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। সিডিউল ফ্লাইট ছাড়াও প্রতি বছর গড়ে ২,১০০টি নন-সিডিউল কার্গো চার্টার ফ্লাইট দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে বিমান, যা এয়ার কার্গো অপারেশনে এর দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিমান কার্গো এখন ইতিহাদ, এমিরেটস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, গালফ এয়ার, এয়ার ফ্রান্সসহ একাধিক শীর্ষ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে SPA, BSA ও কোড-শেয়ারিং চুক্তির মাধ্যমে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কার্গো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং উন্নতমানের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বিমান। ঢাকা হয়ে ট্রানজিট ও ট্রান্সফার কার্গো পরিবহনের ব্যবস্থাও চালু করা হচ্ছে।
এতসব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স শুধু একটি রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স নয়, বরং সংকট মোকাবেলায় সাহস, সিদ্ধান্তে নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যৎ গঠনে অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কার্গো এখন আর কেবল পণ্য পরিবহন নয়—এটি জাতির অগ্রযাত্রা, গর্ব ও বিশ্বজয়ের প্রতীক। আর সেই প্রতীকে নতুন ডানা যোগ করে চলেছে আমাদের নিজস্ব গর্ব, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।