তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যখন প্রতিবেশী দেশগুলোসহ গোটা বিশ্ব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে আইসিটি খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে আছে। যদিও তরুণদের কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক আয় বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এই শিল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তবুও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দক্ষ জনবল ঘাটতি, দুর্বল অবকাঠামো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এনবিআরের অসহযোগিতা এবং সরকারের উদাসীন মনোভাবই এই শিল্পের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইসিটি খাতে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ হলেও তার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের পেছনে ১৬ বছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, ঘোষিত হয়েছিল ২০৩১ সালের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু এই বিশাল বিনিয়োগ বাস্তব কর্মসংস্থান বা রপ্তানি আয় তৈরিতে কতটা কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ।
বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রতিবন্ধকতা যেন চরমে পৌঁছেছে। ফ্রিল্যান্সারদের প্রধান সমস্যা পেমেন্ট গেটওয়ে। বৈদেশিক আয়ের টাকা ব্যাংকে পৌঁছালেও তা তুলতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়তে হয়। মার্কেটপ্লেস, গেটওয়ে, এনবিআর ও ব্যাংকের নানা কর্তনের ফলে ১০০ ডলারের মধ্যে ৪০ ডলারই চলে যায় মধ্যস্থতাকারীদের পকেটে। তাছাড়া দেশে হাইস্পিড ইন্টারনেট ও উন্নত হার্ডওয়্যারের সংকট ফ্রিল্যান্সারদের দক্ষতা কাজে লাগানোর পথেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারপারসন ডা. তানজিবা রহমান বলেন, টেকসই ফ্রিল্যান্সিং গড়ে তুলতে হলে স্কিলড ওয়ার্কার তৈরি, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেমিটেন্স আয়ের ওপর প্রণোদনা, হার্ডওয়্যার আমদানিতে শুল্ক কমানো, ক্রিপটো বৈধকরণ এবং এনবিআরের সোর্স ট্যাক্স বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত জরুরি। দেশে সাড়ে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার থাকলেও মাত্র আড়াই লাখ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের প্রকৃত আয় যেখানে ৫ বিলিয়ন ডলার, বৈধ পথে দেশে আসে মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার।
আইটি ফার্ম টাইগার আইটির নির্বাহী পরিচালক রিফাত আবেদিন জানান, দেশের আইটি উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক বাজারে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। যেমন ব্যাংক গ্যারান্টি জটিলতা, ক্রেডিট রেটিংয়ের দুর্বলতা ও সিকিউরিটি মানির অযৌক্তিক শর্ত। এসব কারণে নেপালসহ অন্যান্য দেশের কাজ হাতছাড়া হয়। তার মতে, আইসিটি খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সামিট আয়োজন, রপ্তানিতে সহায়তা ও তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সঠিক নীতি গ্রহণ জরুরি। তিনি আরও বলেন, দেশের তথ্য ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, যার ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো আস্থা হারাচ্ছে।
এছাড়া, দেশের অনেক বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখনো স্থানীয় কোম্পানিগুলোর বদলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে আইটি সেবা নিচ্ছে। অথচ তাদের ব্যবহৃত তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার সংকটও বড় কারণ।
অন্যদিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক আইটি ফার্মের মহাব্যবস্থাপক আলমগীর কবির বলেন, সরকার সহযোগিতা করলেও দেশের আইটি কোম্পানিগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়নি। অধিকাংশ কোম্পানির জনবল ৪০-৫০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক কাজ পেতে হলে কোম্পানির স্কেল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ফিন্যান্সিয়াল ও অপারেশনাল ক্ষমতা যাচাই করা হয়। অথচ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেই মানে পৌঁছায়নি।
তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির আগমনে কাজের ধরনে বড় পরিবর্তন আসছে। দক্ষতা না থাকলে এই খাতে টিকে থাকা কঠিন হবে। দেশে যেমন দক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি যারা দক্ষ তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন মূল্যায়ন ও নিরাপত্তার অভাবে।
চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা, শ্রম আইনের প্রয়োগ না হওয়া এবং দুর্বল কর্পোরেট কাঠামো দেশের আইটি খাতকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, আইটি কোম্পানিগুলোকেই নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক এক্সপো আয়োজন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নীতিগত সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সম্ভাবনার বিশাল ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো অগোছালো ও অবহেলিত। এই খাতে নীতি, প্রণোদনা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা না আনলে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা শুধু কাগজেই রয়ে যাবে। এখনই সময় এই শিল্পের ভিত মজবুত করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার।