সত্যজিৎ দাস:
২৫ মার্চ ১৯৭১,বাংলাদেশের ইতিহাসের এক দুঃস্বপ্নদায়ক রাত, যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম অভিযান শুরু হয়। “অপারেশন সার্চলাইট” নামক এই কার্যক্রমে, দেশের প্রধান শহরগুলিতে বিস্তীর্ণ গণহত্যা চালানো হয়। নিরীহ মানুষের ওপর চালিত এই নিপীড়ন কেবল এক মানবিক বিপর্যয় ছিল না, বরং এটি এক অসহ্য অবস্হার সূচনা—যেখানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম,অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার আগুন নীরবভাবে জ্বলে উঠেছিল।
তাড়াতাড়ি বিদেশি সাংবাদিকদের এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়,যেন এই নির্মম সত্য বিশ্বমঞ্চে প্রকাশ পেতে না পারে। কিন্তু ইতিহাসে সেসব অন্ধকার রাত চিরকাল মুছে যায়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,সেই অগ্নিস্বপ্নের পৃষ্ঠপোষক,২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা করে—একটি অদম্য সংকল্পের ঘোষণা যা সকল বাঙালিকে মুক্তির পথে একত্রীকৃত করেছিল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক স্বাধীন জাতি,যার সংগ্রাম ও ত্যাগ আজও আমাদের হৃদয়ে বয়ে যায়।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ,জাতীয় সংসদের সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে “গণহত্যা দিবস” হিসেবে গৃহীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপ কেবলমাত্র আমাদের ঐতিহাসিক বেদনা স্মরণ করায় না,বরং আন্তর্জাতিক মহলে এই অপরাধের নৃশংসতার যথার্থ স্বীকৃতি আনার জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
জেনোসাইড ও ওয়াচ,লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই নির্মম গণহত্যাকে গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু এই দিন আমাদের শুধু অতীতের দুঃখের স্মৃতি নয়। এটি একটি সতর্কবার্তা, এক অনন্ত প্রেরণা ও এক জাতির অমলিন সংকল্প। গণহত্যার সেই অন্ধকার অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়—স্বাধীনতা কেবল শাসন বা ক্ষমতার অধিকার নয়,বরং এটি মানুষের আত্মার মুক্তির গল্প। প্রতি প্রজন্মে এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায্যতার পথে যে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে,তা যেন আমাদের ইতিহাসের অমর গৌরব ও ত্যাগের সাক্ষ্য হয়ে থেকে যায়।
আজকের দিন,যখন আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ,তোপধ্বনির সুরে ইতিহাসের দুঃখভরা অধ্যায়কে স্মরণ করি,তখনও আমাদের মনে রাখতে হবে—এই সংগ্রাম ছিল শুধু রক্তক্ষয় নয়,বরং এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছিল এক সমাজের যেখানে সত্য,ন্যায় ও মানবিকতা শাসন করবে।
২৫ মার্চ আমাদের শিখিয়েছে,যে স্বাধীনতা অর্জনের পথে কতো আত্মত্যাগ,কত নির্যাতন এবং কত সাহসের দরকার ছিল। এই দিনটি আমাদের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা,যাতে আমরা ভবিষ্যতের দিকে নির্ভীকতার সাথে এগিয়ে যাই—এক সমাজের স্বপ্ন যেখানে প্রত্যেক মানব জীবনের মূল্য সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতার এই অমর চিহ্নকে স্মরণ করে,আমাদের উচিত সেই সংগ্রামী আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং এক নতুন,ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার পুনর্নবীকরণ করা।