রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ অনুষ্ঠিত হলো ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’-এর আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি। বিকেল ৩টা কিছু পর থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টার দিকে ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে এই কর্মসূচির সমাপ্তি হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি একইসঙ্গে সংহতির বক্তব্যও প্রদান করেন।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি দৃঢ় সংহতি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশিরা ইতিহাসের অন্যায়-জুলুমের সাক্ষী এবং প্রতিবাদের ঐতিহ্য লালন করে আসছে। এই সমাবেশ শুধুমাত্র প্রতিবাদ নয়—এটি একটি শপথ, একটি অঙ্গীকার, গাজার নির্ভীক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ডাক।
ঘোষণাপত্রে প্রথম দাবি তুলে ধরা হয় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। জানানো হয়, গাজার প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ধ্বংস ও রক্তপাত কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। পশ্চিমা শক্তির একটি বড় অংশ ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘায়িত করেছে। এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদারকে প্রতিরোধের বদলে বরং রক্ষার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
এ প্রেক্ষিতে পাঁচটি দাবির কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়—
১. ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা,
২. যুদ্ধবিরতির নামে সময় ক্ষেপণ না করে গণহত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ,
৩. ১৯৬৭ সালের আগের সীমানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা,
৪. পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া,
৫. ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা।
মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূমি নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। গাজা কেবল একটি শহর নয়, বরং এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ওপর দায়িত্ব রয়েছে এই আমানত রক্ষার।
ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বলা হয়, তারা এখন এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিপীড়ন এবং সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইনে হস্তক্ষেপ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়—
১. ইসরায়েলের সঙ্গে সবধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে হবে,
২. ইসরায়েলের ওপর বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করতে হবে,
৩. গাজার জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা, খাদ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে,
৪. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলকে একঘরে করার উদ্যোগ নিতে হবে,
৫. ভারতের মুসলিমবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ওআইসিকে দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও এই কর্মসূচি থেকে ছয় দফা আহ্বান জানানো হয়—
১. ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল ও ইসরায়েল স্বীকৃতি না দেওয়ার স্পষ্ট বার্তা,
২. ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি বাতিল,
৩. গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো,
৪. সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও আমদানিনীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা,
৫. ভারতের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ,
৬. পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে ফিলিস্তিন ও মুসলিম ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা।
সবশেষে, কর্মসূচির অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের প্রতি কিছু প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আল-কুদস কেবল একটি শহর নয়, বরং ঈমানের অংশ। বাইতুল মোকাদ্দাসের মুক্তি অন্য কারো দ্বারা নয়—আমাদের প্রজন্মের হাতেই তা হতে হবে। নিজেদের আত্মবিস্মৃতিই আজ জায়নবাদী শক্তির সাহসিকতা।
তাদের প্রতিজ্ঞা—
– ইসরায়েলি সমর্থিত সব পণ্য ও কোম্পানি বর্জন,
– ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইসলাম ও উম্মাহর ঐতিহ্য রক্ষায় প্রস্তুত করা,
– আত্মত্যাগে প্রস্তুত সন্তানদের গড়ে তোলা,
– বিভাজন নয়, বরং ঐক্যকে শক্তি হিসেবে ধারণ করা।
তারা বলেন, গাজার শহীদরা আমাদের কাছ থেকে শুধু দোয়া নয়—প্রস্তুতির প্রত্যাশা করেন। আজ যদি আমরা প্রস্তুত না হই, কাল আমাদের সন্তানেরা এমন একটি বাংলাদেশ পেতে পারে, যেখানে হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ মিলে নতুন এক গাজা তৈরি করবে।
সমাবেশের সমাপ্তিতে গাজার সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়—
আপনারা ঈমান, ধৈর্য ও কুরবানির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা পুরো বিশ্বকে ঈমানদারিত্বের সংজ্ঞা বুঝিয়ে দিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও আপনারা প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছেন। আপনারা ইতিহাসের পাতায় নাম রেখে গেছেন সম্মানের খতিয়ানে।
শেষে গাজার শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দোয়া করা হয়—
হে আল্লাহ, গাজার এই সাহসী জনপদকে সেই পাথরে পরিণত করো, যার ওপর গিয়ে ভেঙে পড়বে জায়নিস্টদের সব ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গাজার জনগণকে সালাম ও ভালোবাসা জানিয়ে কর্মসূচির ইতি ঘটে।