মাসুম মিয়া: জাককানইবি প্রতিনিধি:
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো নতুন করে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির উদ্যোগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

(২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) দুপুর বারোটার পর নজরুল ভাস্কর্যের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তবুও প্রতিবাদীদের কণ্ঠস্বর ছিল স্পষ্ট, দৃঢ়— “ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করো!”
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের অন্যতম প্রেরণা হয়ে ওঠে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত কিছু চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী:
৩ ফেব্রুয়ারি: কুমিল্লায় এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
১০ ফেব্রুয়ারি: চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে তার নিজ বাসায় ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারি: রাজধানীতে এক গৃহবধূকে নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
২০ ফেব্রুয়ারি: বরিশালে এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৬ মেয়ে শিশুসহ ৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
সমাবেশে বক্তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তীব্র নিন্দা জানান এবং দোষীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে কঠোর শাস্তির দাবি করেন। শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের সমাজে এক বিভীষিকার রূপ নিয়েছে। একে যদি এখনই রুখে না দাঁড়ানো হয়, তবে আগামী দিনে এ অন্ধকার আমাদের সকলকেই গ্রাস করবে।”
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন।
ধর্ষণের মামলাগুলোর তদন্তে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দূর করা।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা বলেন, “সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া সমাজ থেকে এই অভিশাপ দূর করা সম্ভব নয়। আইন কঠোর হতে হবে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন আরও কঠোরতর হওয়া জরুরি।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নারীর নিরাপত্তা জোরদার করতে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে। তবে জাতীয় পর্যায়ে প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা নিয়ে এখনও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের কারণসমূহ বহুমুখী— সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক শিক্ষার অভাব, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, ও অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “শুধু আইনের কড়াকড়ি নয়, সামাজিক আন্দোলনই পারে এই ব্যাধির মূলোৎপাটন করতে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”
বৃষ্টি উপেক্ষা করেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন। কর্মসূচির একপর্যায়ে তাঁরা প্রশাসনের কাছে তাঁদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন এবং নজরুল ভাস্কর্য থেকে জয়ধ্বনি মঞ্চ পর্যন্ত একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করেন।
সমাবেশের শেষে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বাড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেন।
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ দমন করতে হলে কেবল প্রতিবাদই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন কার্যকর প্রতিরোধ ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান। আজকের এই প্রতিবাদ শুধু একটি কর্মসূচি নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলনের ইঙ্গিত দেয়। আইন, প্রশাসন, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা সম্ভব।
এক শিক্ষার্থীর কণ্ঠে প্রতিবাদের মর্মবাণী ধ্বনিত হয়, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই মানবতার প্রকৃত দায়িত্ব। আমরা নিশ্চুপ থাকব না, প্রতিবাদ থামবে না, এই যুদ্ধ চলবেই—যতক্ষণ না সমাজ থেকে ধর্ষণের অভিশাপ দূর হয়।”