মুহাম্মদ আল্-হেলাল
১৯৯৮ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ফ্রান্সই চ্যাম্পিয়ন হয়। সে বছর বাংলাদেশ সময় ফজর সালাত বাদে ফাইনাল ম্যাচ খেলার কিছু অংশ দেখার সুযোগ হয়েছিল।
২০০০ সাল পর্যন্ত রেডিও বাংলাদেশে দুপুর ১.৪৫ মিনিটে বাংলা ছায়াছবির গানের একটি অনুষ্ঠান হতো বলে মনে পড়ে। এছাড়া বিভিন্ন সময় রেডিও বাংলাদেশের ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি সেন্টারে অনুরোধের আসর গানের ডালি নামে অনুষ্ঠান হতো।
টেলিভিশন সেন্টার বলতে শুধু ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবার জুমার সালাতের পর বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য পাড়া মহল্লায় ধুম পড়ে যেত। তখন এক পাড়ায় হয়তো ১০০/২০০ পরিবারের মধ্যে একটি টেলিভিশন পাওয়া যেত। তাছাড়া এশার সালাতের পর আলিফ লায়লা দেখার জন্য শিশু, বৃদ্ধ, নারী পুরুষ সকলকে টেলিভিশনের সামনে হাজিরা দিতে দেখা যেত।
পিড়ি, টুল, চেয়ার, বেঞ্চ যার যার বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হতো এমনকি কেউ কেউ হাস-মুরগী, আটকানো বা মাছ ধরার জন্য বাঁশের তৈরি পোলো এনে তার উপরও বসতেন। আর অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখতেন। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আবার বসা থেকে উঠে দাড়ানোদের বসতে দিতেন।
সেকালে টেলিভিশনের মালিকের এত লোকের বসার জন্য ব্যবস্থা করার সক্ষমতা ছিলনা। কিন্তু জায়গার অভাব হতোনা। কেননা এধরনের প্রোগ্রামের সময় টিভি উঠানে রাখা হতো। তবে টিভির মালিকের পক্ষ থেকে অল্প কিছু সম্মানিত লোকের বসার ব্যবস্থা থাকত। আমাদের নড়াইল জেলার, লোহাগড়া উপজেলার রসুলপুর গ্রামের মধ্যে প্রথমদিকে যাদের বাড়িতে টিভি ছিল তাদের মধ্যে খোকন মামাদের উঠানে সবচেয়ে বেশি জায়গা ছিল। বর্তমান যুগের প্রায় ফুটবল খেলার মাঠের মতো।
তখনকার দিনে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ হয়তোবা শুধু আমার মামাদের বাড়িতেই ছিল। টেলিভিশন চলতো ব্যাটারির মাধ্যমে। বিজ্ঞাপন বা খবরের সময় হলে টেলিভিশন বন্ধ করা হতো। এই বিরতির সুযোগ যারা যারা বসে বসে অনুষ্ঠানে দেখতেন তারা এস্তেঞ্জায় যাওয়া বা ঘুরে আসার সুযোগ পেতেন। এই সুযোগে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো একটু বসে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজতেন।
সে সময় টিভিতে নাটক, সিনেমা দেখার ন্যায় মানুষ গল্প, নাটক, উপন্যাসের বইও পড়তেন। দিন যাচ্ছে আর মানুষের বিভিন্ন অভ্যাস, রুচি এবং চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। সাথে সাথে সচেতন মানুষের টিভিতে নাটক, সিনেমা বা গান দেখার অভ্যাস, চাহিদা, রুচির জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে সংবাদ, সংবাদ ভিত্তিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। বইয়ের ক্ষেত্রেও গল্প উপন্যাসের জায়গায় এখন মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ইসলামিকসহ, সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত বা লিখিত সচেতনতা বৃদ্ধির জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের সংবাদ ভিত্তিক প্রামাণ্য বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান চলছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ সারাদেশে বই মেলা। এই বই মেলার সাথে সংশ্লিষ্ট বা গল্প উপন্যাসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অনুমান করা সহজ কোন ধরনের বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বা হ্রাস পাচ্ছে।
অনেক গুলো গল্প উপন্যাসের প্রনেতা এমন একজনের ফেসবুক পোস্ট এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি পোস্ট করেছেন, এত কষ্ট করে বই মেলায় যাই অথচ বেচাবিক্রির যে অবস্থা তাতে বইমেলায় আর যেতে ইচ্ছে করছেনা।
বর্তমান যুগে মানুষ টিভিতে নাটক, সিনেমা বা গান দেখার জন্য আর হুমড়ি খেয়ে না পড়লেও দেশ বা বিদেশের খবর রাখে ঠিকই এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনের মাধ্যমে, নির্মিত প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখে বা লিখিত এধরনের সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা বই পাঠের মাধ্যমে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে অসংখ্য সংবাদ ভিত্তিক টিভি চ্যানেল, এফ এম রেডিও, অনলাইন রেডিও, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি দেখেও স্পষ্ট বোঝা যায় ৯৫% মুসলিম অধ্যুষিত জনসংখ্যার দেশে বাস্তবভিত্তিক, সংবাদ ভিত্তিক, প্রামাণ্য বা ইসলামিক সৃজনশীল কাজের চাহিদা কিভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একসময় আমি নিজেও রেডিও বা টেলিভিশনে কখন কোন অনুষ্ঠান হবে তা লিখে রাখতাম। কিন্তু এখন ফুটবল বিশ্বকাপ, ক্রিকেট বিশ্বকাপ বা কোন নাটক, সিনেমার কোন অনুষ্ঠান কোন দিক দিয়ে চলে যায় তা টেরও পাইনা। তবে অনেকের মতো আমিও সকালে ঘুম থেকে উঠে অনলাইনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিউজ হেডলাইন, সন্ধ্যা ৭ টার টিভির খবরটা সম্পূর্ণ দেখার চেষ্টা করি। কেননা সন্ধ্যা ৭ টার খবরে সাধারণত দিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খবর গুলো পাওয়া যায়।
আবার সপ্তাহে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো জানার জন্য সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সন পড়ি। সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। এজন্য কর্তৃপক্ষের নিকট কৃতজ্ঞ।
মানুষ ফিকশনাল বা কাল্পনিক গল্প, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি বিমুখ হয়ে দালিলিক বা বাস্তবভিত্তিক খবর, অনুষ্ঠান বা বইয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে তাই লেখক, গবেষক, নির্মাতাদের এসকল সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে মানুষের চাহিদার দিকে নজর দেওয়া যেমন জরুরি তেমন এ ধরনের কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করাও সময়ের দাবি।
এমফিল গবেষক(এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়