বিধান মন্ডল ফরিদপুর প্রতিনিধি:
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদি ইউনিয়নের চন্ডীবর্দি গ্রামের মান্দার মোল্লা(৪৭) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন(স্থানীয়দের বিবরণে)। পরে ওই দিন রাতেই ঢাকা থেকে তার লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসে পরের দিন সকাল ১০ টায় দাফন সম্পন্ন করা হয়। আর এই মৃত্যুর ঘটনার প্রায় এগারো মাস পর গত ২০২৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী হেনা বেগম। এ যেন এক মৃত্যু নিয়ে দুই মৃত্যুর গল্প!
আর এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন ও চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে জেলা জুড়ে। মান্দার মোল্লা মৃত্যুর ঘটনার প্রায় নয় মাস আগে মারা গেলেও তার স্ত্রী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মৃত্যু দেখিয়ে মামলা করেছেন। কেন এবং কি কারনে তিনি তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয় নিয়ে এমন মামলা দায়ের করলেন এই প্রশ্নটি এখন এলাকার অনেকের। ধারণ করা হচ্ছে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্যই তিনি হয়তোবা এমন কাজটি করেছেন। এর সাথে জড়িত রয়েছে একটি চক্র।
মামলার এজাহারে মামলার বাদী মৃত মান্দার মোল্যার স্ত্রী হেনা বেগম উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই ঢাকার মিরপুর গোল চত্বরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মিরপুর গোলচত্বরের সামনে তার স্বামীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মামলাটিতে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে ও ১০/১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা করে ঢাকার আদালতে এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন তিনি। পরে মামলাটি মিরপুর মডেল থানায় ওই মাসের ২৬ সেপ্টেম্বর রেকর্ড করা হয়।
মামলার এজাহারে আরো জানা যায়, মামলার এক নম্বর আসামি মোহাম্মদ রাসেল ওরফে সরোয়ার জামাল রাসেলের(২৫) নির্দেশে মান্দার মোল্লার বসবাস নিশ্চিত হয় তারা। এরপর ভিকটিমকে ১৮ জুলাই কৌশলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল নিয়ে যায়। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় আন্দোলন শেষে রাতে বাসায় ফেরার পথে ঘটনাস্থলের রাস্তার উপরে ওত পেতে থাকা আসামিগণ উক্ত ভিকটিমকে স্থানীয় মিরপুর ২ নং সুইমিংপুল ও ২ নং স্টেডিয়ামের মাঝে এলাকায় জোর করে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল আগে থেকেই থাকা ১নং আসামি সহ অন্যরা মান্দার মোল্লাকে সামনে পেয়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে গলায় পাড়া দিয়ে ধরে ও পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর আসামিগণ মান্দার মোল্লার লাশ ওখানে ফেলে পালিয়ে যায়।
আর এই হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে সম্প্রতি সময়ে মামলার বাদী হেনা বেগমের সালথার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সরাসরি কথা বললে তিনি বলেন, কেউ কখনো হত্যা মামলা দিতে চায় না। তবে কারণ রয়েছে বলেই হত্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আপনারা যদি আসামিদেরকে একজনকে হাজির করতে পারতেন তাহলে একটা কথা ছিল, আমারও কিন্তু সন্তান রয়েছে। এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে বিপদে ফেলতে চায় না। মনে বড় কষ্ট আছে, অনেক কারণ আছে। তারা আমাকে বিপদে ফেলেছে ওই ঢাকার লোকজন। তাদের গার্জিয়ান রয়েছে তাদের আমার বাড়িতে আসতে বলেন মুখে মুখে একটা আপোষ মীমাংসা হয়ে যাক। তিনি বলেন, মামলা নিয়ে একটি সমাধান হয়ে গেছে এটা নিয়ে এখন আর আপনাদের কাছে আমি আর কি বলবো। মামলার আসামি পক্ষকে আমার কাছে আসতে বলেন। আমার সাথে কথা বলুক তাহলে সমাধান হয়ে যাবে।
এরপর তিনি বলেন আপনারা এলাকাবাসীর কাছে মৃত্যুর তারিখ নিয়ে যা শুনেছেন তাই লিখে দিন।
মান্দার মোল্লার প্রতিবেশী মোঃ বাবলু মোল্লা জানান, ২০২৩ সালের ৪ঠা আগস্ট মান্দার মোল্লা মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায়। এর আগে ১২ বছর তিনি এলাকা ছাড়া ছিলেন। তিনি বলেন আমরা শুনেছি তিনি ঢাকায় রিক্সা চালাতেন। ঢাকায় রিক্সা চলাকালীন অবস্থায় হার্ট স্টোক করে তার মৃত্যুবরণ হয়। যারা লাশ নিয়ে তখন এসেছিলেন তারাই আমাদের কাছে বলেছেন। গত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মান্দার মোল্লার মৃত্যুর ঘটনার কথা শুনতেই তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি বিষয়টিকে একটি প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করেন।
এলাকার আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ নাসির বলেন, মান্দার মোল্লা যখন মারা যায় তখন আমরা তার জানাজায় অংশ নিয়েছিলাম। তার মৃত্যু দেখে কখনো মনে হয়নি অস্বাভাবিক কোন মৃত্যু, স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আমরা জানি। তার মৃত্যু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েক মাস আগেই বলেই তিনি জানান।
গত ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ৪ তারিখে ফেসবুকে মান্দার মোল্লার মৃত্যুর জানাজা শেষে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন বল্লভদি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো: অলিউর রহমান। এই মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেন, মান্দার মোল্লা এক থেকে দেড় বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি নিজেও সেই জানাজাতে অংশ নিয়েছিলাম। তবে গত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার মৃত্যু হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। ঢাকা থেকে অনেকেই এসেছিলেন আমাদের কাছে। সেখানেও আমরা সত্যি কথাটি বলেছি। কেউ বিপদে পড়ুক এমনটা আমরা চাই না।
মামলার এক আসামি একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত বিজয় দত্ত বলেন, আমার একটি নিউজ নিয়ে একটি পক্ষ অখুশি ছিল। আর এই কারণে এই মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ওই পক্ষ।
এই মামলার ১ নং সাক্ষী মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, আমি এই মামলা সমন্ধে কিছুই জানি না। যখন মামলার নোটিশ এসেছে তখন আমি জানতে পারি।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মান্দার মোল্লার বাড়ি থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে দেয়া হয়েছে তার কবর। একটি বাগানের ভিতর দেয়া কবরের চিত্রই বলে দিচ্ছে বেশ অনেকদিন আগেই কবরটি দেয়া হয়েছে। কবরের দেয়ার আশেপাশের স্থানীয়রা জানান এক থেকে দেড় বছর আগে এখানে এই কবরটি দেয়া হয়েছে। সে সময় দেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক ছিল এবং শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় ছিল। তবে ছাত্র আন্দোলনে সময় মান্দার মোল্লা মারা যায়নি এই কথাটি ওই এলাকার বাসিন্দারা বার বারই জানান সাংবাদিকদের।
সালথায় এরকম প্রতারক মামলাবাজদের নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে জেলা জুড়ে। যে মামলা গুলোতে সালথা এলাকার অনৈতিক সুবিধাবাদী লোক বাদী হয়ে নিরীহ ধনীক ব্যবসায়ী ও ঘটনার সাথে জড়িত নয় তাদের নামে মামলা দেয়া হয়। এরপর বাদী মামলার কপি আসামিদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে টাকা দাবির করার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও সালথা এলাকায় কিছু দিন আগে একটি মেলায় একটি হত্যাকান্ডকে ঘিরে এলাকার নিরীহ মানুষজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে সেই মামলার বাদীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা দায়ের করেন।
এভাবে সালথা এলাকায় একে অপরকে ফাঁসাতে এবং অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের জন্য প্রতারক চক্র বিভিন্ন সময়ে এই অপকর্মগুলো করে আসছে।
উপজেলার বিশিষ্টজনদের দাবি এইসব অপকর্মের হোতা মামলাবাজ এবং অনৈতিক সুবিধাবাজদের বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।