দেশে সাংবাদিকতা যখন হাজারো প্রতিকূলতা ঠেলে জনগণের সত্য প্রকাশের দায়িত্ব পালন করছে, ঠিক তখনই নতুন এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সময়ের কণ্ঠস্বরের কক্সবাজারের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শাহীন মাহমুদ রাসেল। অভিযোগ উঠেছে, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এডি) এ.কে.এম দিদারুল আলম সাংবাদিক শাহীনকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
ঘটনার পটভূমি
জানা গেছে, রবিবার (৯ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল তার ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে রাশেদা নামের এক নারী অভিযোগ করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা দিদারুল আলম তার স্বামী সিএনজি চালক বজল করিমকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে রাসেল লেখেন, “অপকর্মে মশগুল মাদকদ্রব্যের এডি দিদারুল। মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া সিএনজি চালক বজল করিমের স্ত্রী রাশেদের আহাজারি!”
এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় দিদারুল আলমের প্রতিশোধপরায়ণ প্রতিক্রিয়া। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আটক এক আসামির মাধ্যমে সাংবাদিক রাসেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় এবং সেটিকে একটি অনলাইন পোর্টালের ফেসবুক পেইজে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। তবে সেই লাইভ ভিডিওতে এডি দিদারুলের কোনো বক্তব্য ছিল না।
সাংবাদিকের বক্তব্য
সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, “এক সিএনজি চালককে (বজল করিম) কোনো মাদক ছাড়াই দীর্ঘক্ষণ একটি গাড়ির গ্যারেজে আটক রাখা হয়েছিল। এ বিষয়ে এডি দিদারুল আলমের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি একবার বলেন কলাতলি থেকে আটক করেছি, আরেকবার বলেন লিং রোড থেকে আটক করেছি। আমি যখন তাকে প্রশ্ন করি, ‘লিং রোডে এত গ্যারেজ থাকতে আপনাকে আপনার অফিসের পাশের গ্যারেজে কেন নিয়ে এলেন? জনসম্মুখে ইয়াবাগুলো কেন উদ্ধার করলেন না?’ তখন তিনি আমার সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু করে কল কেটে দেন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এডি দিদারুল আমার বিরুদ্ধে যে ছেলেকে দিয়ে অভিযোগ আনাচ্ছে, সেই ছেলের সাথে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ, ফোনে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কথা হয়নি। যদি কথা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা প্রমাণ করুক। কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক, উপপরিদর্শক এবং এডি দিদারুল আমার উপর অনেক আগে থেকেই ক্ষিপ্ত। কারণ, আমি পত্রিকায় ‘মাদক নির্মূল কর্মকর্তাদের নাটকীয় অভিযান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। সেই প্রতিবেদনে তাদের সমস্ত অপকর্মের কথা উঠে এসেছে।”
এডি দিদারুলের ভিডিও বার্তা
এদিকে, এই ঘটনার পর এডি দিদারুল আলম একটি ভিডিও বার্তায় বলেন, “আজকে (রবিবার) দুপুরে সিএনজিসহ একটা আসামি ধরেছিলাম ১৮’শ পিস ইয়াবা নিয়ে। তারপর সাংবাদিক আমাকে হুমকিও দিয়েছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছে কেন আমি তাকে ধরলাম। এরপর আমরা আপনাদের সাংবাদিক মহলে বিষয়টি অবগত করেছি, অলরেডি সেই আসামি আপনাদের সামনে বক্তব্য দিয়েছে যে মালগুলো কার। সে বলছে, সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলের।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো অপরাধী শত্রুতাবশত বা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে যে কারও নাম বলতে পারে। তাই এমন অভিযোগ যাচাই না করে প্রচার করা আইনসম্মত নয়। আইনের মূল উদ্দেশ্য অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন সেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই অপরাধের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় দাঁড়াবে?
সাংবাদিক সমাজের প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় কক্সবাজার জেলার মূলধারার সাংবাদিক মহল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রাষ্ট্রীয় সংস্থা যদি সাংবাদিকদের দমনে নেমে পড়ে, তাহলে সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কি চায় – সত্য গোপন থাকুক? এই প্রহসন কেবল সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সুস্পষ্ট চেষ্টা।”
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ডিএনসি) কাজী গোলাম তওসিফ হোসেন সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুক্তভোগী সাংবাদিককে লিখিত অভিযোগ দিতে বলুন, আমি ডিজিকে বলে দিচ্ছি, দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মমতাজ তানভীর ও চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেছেন, “কোনো আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি না দিলে বা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে অন্য কারও নাম উল্লেখ না করলে তাকে আসামি করা যায় না। পাবলিক প্লেসে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কাউকে অভিযুক্ত করাও আইনসিদ্ধ নয়। বিষয়টি আমরা মৌখিকভাবে অবগত হয়েছি এবং গুরুত্ব সহকারে দেখছি।”
এডি দিদারুলের বিতর্কিত ইতিহাস
এডি দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ২০১৩ সাল থেকে একই পদে থাকা এই কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় নানা অপকর্মের জন্য আলোচনায় এসেছেন। তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মাদক মামলায় নিরীহ মানুষকে ফাঁসানোর মতো অভিযোগ উঠেছে। ২০২৩ সালে তাকে চাঁদপুর থেকে জামালপুর বদলি করা হলেও, তিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।
এই ঘটনা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই বিষয়ে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।