বাংলাদেশের ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের স্থবিরতা ও প্রত্যাশা-ব্যর্থতার চক্র চলছিল। তবে সেই বৃত্ত ভাঙার ইঙ্গিত যেন পাওয়া গেল ৪ জুন, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যেখানে দেশের ফুটবলপ্রেমীরা প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠে জাতীয় দলের জার্সিতে দেখলেন প্রিমিয়ার লিগ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা চৌধুরীকে। আর এই দিনটি শুধু তার জন্য নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের জন্যও হয়ে রইল ঐতিহাসিক। অভিষেক ম্যাচেই গোল করে ও পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত পারফর্ম করে হামজা যেন নতুন আশার দ্বার খুলে দিলেন।
হামজা চৌধুরীর ঝলকে জয় পেল বাংলাদেশ
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে নতুন ইতিহাস গড়লেন হামজা চৌধুরী। দেশের মাটিতে প্রথমবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়িয়ে খেলতে নেমেই দুর্দান্ত গোল করে আলোড়ন তুলেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচের মাত্র ষষ্ঠ মিনিটেই কর্নার কিক থেকে হেডে গোল করেন হামজা।
দাপুটে শুরু, দুর্দান্ত সমাপ্তি
ভুটানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে শুরু থেকেই ছিল বাংলাদেশের আগ্রাসী মনোভাব। কোচের পরিকল্পনা ছিল স্পষ্ট—শুরু থেকেই চাপে ফেলে গোল আদায় করে নেওয়া। পরিকল্পনার বাস্তবায়নও হলো খুব দ্রুত। মাত্র ষষ্ঠ মিনিটেই কর্নার কিক থেকে উঠে আসা বলটি অসাধারণ দক্ষতায় হেড করে জালের ঠিকানায় পাঠান হামজা চৌধুরী। গোলের পরই স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজারো দর্শকের কণ্ঠে উঠে আসে “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” ধ্বনি, যা যেন দীর্ঘদিনের এক অবদমিত আবেগের বিস্ফোরণ।
হামজার উপস্থিতি: শুধু নাম নয়, নেতৃত্বও
শুধু গোল করেই থেমে থাকেননি হামজা। মাঝমাঠে তাঁর উপস্থিতি পুরো খেলায় ভারসাম্য এনে দিয়েছে। বল কন্ট্রোল, পাসিং, ট্যাকলিং—সবখানেই ছিল তার পরিণত ও সংযত পারফরম্যান্স। মনে হয়েছে, সে যেন বহু বছর ধরেই এই দলে খেলছেন। প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা যেন তার প্রতিটি মুভমেন্টে প্রকাশ পাচ্ছিল। এটি ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচ হলেও, দেশের মাটিতে এটি ছিল প্রথম।
দ্বিতীয়ার্ধে সোহেল রানার জাদু
প্রথমার্ধে গোলের পর আরও কয়েকটি সুযোগ পেলেও ব্যবধান বাড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। ফাহমিদুল, মোরসালিন ও জামালের শটগুলো প্রতিহত করেন ভুটানের গোলরক্ষক জিয়েলশেন জাংপো। তবে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ৪৯ মিনিটেসোহেল রানা দূর থেকে একটি শক্তিশালী শট নিয়ে গোল করেন। তাঁর বাঁ পায়ের শটে বল সরাসরি জালে চলে যায়, গোলরক্ষক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
মিতুলের দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো
ভুটান অবশ্য হার মানতে চায়নি। দ্বিতীয়ার্ধে দুই দফায় তারা আক্রমণে উঠলেও বাংলাদেশের তরুণ গোলরক্ষক মিতুল মারমার দৃঢ় অবস্থান সেই প্রচেষ্টাগুলোকে ব্যর্থ করে দেয়। বিশেষ করে ম্যাচের শেষদিকে জিগমে নামগিয়ালের একক প্রচেষ্টা যেভাবে রুখে দেন মিতুল, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তাঁর সেভগুলোর কারণেই বাংলাদেশ কোনো গোল হজম না করে ম্যাচটি জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।
হামজার আগমনে নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশের ফুটবলে এমন কোনো খেলোয়াড় এর আগে আসেননি, যিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো উচ্চপর্যায়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন। হামজা চৌধুরীর উপস্থিতি শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, পুরো দলের আত্মবিশ্বাসের জায়গাটিও বদলে দিয়েছে। ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়রা যেভাবে তাঁর প্রশংসা করেছেন, তাতে বোঝা যায় তিনি এখন শুধু একজন ফুটবলার নন, বরং একজন অনুপ্রেরণার নাম।
ফুটবল ফিরে পেল প্রাণ
বাংলাদেশের ফুটবল অনেকদিন পর এমন একটি ম্যাচ উপহার দিতে পারল যা সমর্থকদের মুখে হাসি ফিরিয়ে এনেছে। হামজার মতো একজন তারকা খেলোয়াড়ের আগমনে শুধু দল নয়, দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদাও নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। স্টেডিয়ামে থাকা হাজারো দর্শকের উল্লাস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামজাকে ঘিরে আলোচনার ঝড়—সবই ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে।