অস্ত্র ব্যবসায়ী মুন্নার উত্থান বিস্ময়কর : এখনও রয়েছেন অধরা
সিলেট:
২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট ছাত্র জনতার উপর হামলার নেতৃত্বকারি, যুবলীগের মুন্না এখনও অধরা। সিলেট জেলা ও মহানগর যুবলীগের সাধারন কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোন এক অদৃশ্য হুকুমে সিলেট মহানগর যুবলীগের ১ম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মুন্না রয়ে গেছেন মামলার বাহিরে। কয়েকটি সুত্র থেকে জানা যায়, মুন্নার ‘হট’ সম্পর্ক থাকার কারনে তার উপর কোন মামলা হয়নি। সুত্র বলছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি নিজেকে মামলা থেকে বাচিয়ে রেখেছেন। অথচ এই মুন্না ছিলেন যুবলীগের একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী।
পাইপগান মুন্নার উত্থান : ছিলেন অস্ত্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন দলের দালাল, হয়ে গেলেন যুবলীগ সিলেট মহানগরের ১ম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক! সেই সাথে অবৈধ পন্হায় কামিয়ে নিয়েছেন টাকা, গড়ে তুলেছেন পাহাড় সমান সম্পদ। তৈরী করেছেন কিলার বাহিনী। সেই বাহিনী দিয়ে গত ৪ আগষ্ট হামলা চালানো হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উপর। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় এখনও থেকে গেছেন মামলার বাহিরে!
মুন্নার জন্ম জগন্নাথপুর উপজেলায়। তার শৈশব ও কিশোর কেটেছে অজ পাড়াগায়ে। যুব বয়সে তিনি তার এক আত্বীয় মাধ্যমে সিলেট আসেন জীবিকার তাগিদে। তখন মেজরটিলায় তার এক আত্বীয়র বাসায় উঠেন সেখানেই তৈরী করেন আস্তানা।
এরপর আওয়ামিলীগের খসরুজ্জামান খসরুর মাধ্যমে বাকশালের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন মুন্না। তখন থেকেই তিনি অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ঐ সময় কাশ্মীর গ্রুপ ছিল সিলেট শহরে সবার মুখে মুখে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কাশ্মীর গ্রুপে একজন অস্ত্র সাপ্লাইয়ার হিসেবে মুন্নাও জায়গা করে নেন।
১৯৯২/৯৩ সনের দিকে মুন্না পুরোধমে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি শুধু কাশ্মীর গ্রুপ না তখনকার সময়ে অন্যান্য গ্রুপেও অস্ত্র বা বন্দুকের কার্তুজ সাপ্লাই দিতেন। সে সময় অস্ত্রের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিল বন্দুকক ও পাইপ গান তবে মুন্না সাপ্লাই করতেন পাইপগান ও কার্তুজ যার কারনে সে সময় সবাই তাকে পাইপগান মুন্না হিসেবে চিনত। তখনকার সময় তার ব্যবসায়ী পার্টনার ছিলেন, বাবলু, সুমন, হুসু, জামিল, রাজুসহ কয়েকজন।
ঐ সময় পুলিশের কাছে বাবলু, সুমন ও মুন্না অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। সে সময় তাদের কাছ থেকে পুলিশ ৪ টি পাইপগান, ১০ টি ৩ নট ৩ রাইফেলের গুলি, ২০ টি বন্দুকের গুলি ও ১০ টি রামদা উদ্ধার করে। দীর্ঘ ৬ মাস জেল কেটে বের হয়ে মুন্না ফের শুরু করেন অস্ত্রের ব্যবসা। সেই থেকে শুরু করে গত ৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত ছিল তার অস্ত্রের ব্যবসা।
মুন্না নিজেকে ঠিকাদার পরিচয় দিলেও আড়ালে ছিল অস্ত্র ব্যবসা। ১৯৯৭/৯৮ দিকে কাশ্মীর গ্রুপের অবস্হান চলে গেলে চতুর মুন্না চলে আসেন টিলাগড় গ্রুপে তখন টিলাগড় গ্রুপ ছাড়া তার উপায় ছিলনা। কিন্তু টিলাগড় গ্রুপে থেকে তিনি শুরু করেন অন্যান্য দলের দালালি। যার জন্য তাকে কিছু উত্তম মাধ্যমও দেয় টিলাগড় গ্রুপের কয়েকজন। জানা যায়, টিলাগড়ের সকল খবরা খবর মুন্না পৌছে দিতেন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কাছে। বিনিময়ে তখনকার সময়ে তিনি ছাত্রদলের হাতে ছিলেন সুরক্ষিত। মুন্নার সেই ধারাবাহিকতা আজও বজায় রয়েছে। আজ পর্যন্ত তার সু-সম্পর্ক রয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোকদের সাথে।
যার কারনে তিনি সিলেট মহানগর যুবলীগের ১ম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হয়েও মামলা থেকে নিজেকে বাচিয়ে নিয়েছেন। অথচ এই মুন্নার বন্দুক দিয়েই গত ৪ আগষ্ট গুলি করা হয় এমনকি তার নেতৃত্বে হামলা চালানো হয় ছাত্র-জনতার উপর এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে কয়েকটি সুত্র।
এদিকে চতুর মুন্না ফাঁদে ফেলে হাজেরাকেও বিয়ে করে নেন। সেই সাথে আওয়ামিলীগের ক্ষমতাবলে বিনা ভোটে তার স্ত্রী হাজেরাকে বিজয়ী করে কাউন্সিলরও বানিয়ে ফেলেন।
১৯৯৩ থেকে ২০২৪ সাল, সুত্র বলছে এই সময়ের মধ্যে মুন্না কামিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। তার মধ্যে টিলাগড় গরুর হাট থেকে তিনি কামিয়েছেন কয়েক লাখ টাকা। জোর পুর্বক ঠিকাদারী, বালু-পাথর সাপ্লাই, টেন্ডারবাজি, অস্ত্র ও সোনা চোরাচালান, চিনি পাচারসহ অবৈধ যত কাজ ছিল সবগুলোতে ছিল তার হাত। রাতারাতি হয়ে উঠেন বাড়ি-গাড়ির মালিক।
সুত্র বলছে, মুন্নার প্রতিপক্ষ যেই হত তাকে তিনি তার কিলার বাহিনী দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাতেন। যুবলীগের গত কমিটিতে মুন্না তার অবস্হান পাকাপোক্ত করতে গিয়ে যুবলীগের মুশফিক জায়গীরদারকে চিরতরে সরানোর চক্রান্ত করেন।
২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি রাতে টিলাগড় পয়েন্টে (বর্তমানে যুবলীগের সাধারন সম্পাদক) মুশফিক জায়গীরদাকে মারতে গিয়ে মুন্নার কিলাররা টিলাগড়ের রাজন, মাবরুর ও নিহত তানিমের উপর হামলা চালায়। ঐ হামলায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রাজন, মাবরুর ও তানিম আহত হন। এ ঘটনায় দুইজন সুস্হ্য হলেও রাজনের এক পা সারাজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়।
এখানেই ক্লান্ত হননি মুন্না, তিনি তার বন্ধু টিলাগড়ের তারেককে ঘায়েল করতে তারেকের স্ত্রী পপির নামেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করান যার প্রমান পাওয়া গেছে।
সিলেট শাহপরান থানা নির্মিত হওয়ার পর মুন্নার তৎপরতা বেড়ে যায়। তিনি থানার ওসিদের নিয়ে প্রতিদিন আসর বসাতেন। মদ আর নারীতে মেতে উঠতেন ওসিসহ মুন্না ও তার বন্দুরা। বিনিময়ে তিনি ওসিকে দিয়ে নানা অন্যায় কাজ হাসিল করে নিতেন। এর মধ্যে সব থেকে বেশী অন্যায় কাজ করিয়েছেন তৎকালিন ওসি আকতারকে দিয়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর টিলাগড় আজমির হোটেলে ও মুন্নার অফিসে বসত আড্ডা। বিনা অপরাধে মিথ্যা মামলায় আটক করাতেন লোকজনকে। এর মধ্যে দালাল হিসেবে কাজ করতেন সেলিম উরফে মাটি সেলিম। গত ৫ আগষ্টের পর মুন্না ঘা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এ পর্যন্ত যুবলীগের অনেক নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও সিলেট মহানগর যুবলীগের ১ম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হয়েও মুন্নার বিরুদ্ধে হয়নি কোন মামলা! যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রকাশ্যে হামলায় অংশ নিতে মুন্নাকে দেখা গেলেও অদৃশ্য হাতের ইশারায় মুন্না রয়ে গেছেন মামলার বাহিরে?