শুক্রবারে বিবাহ বা বিশেষ কোনো কার্যক্রম নয়: ইয়াওমুল জুমআর জন্য ইয়াওমুস সাবতি অনুসরণীয়
উবেল সরকার (ছদ্মনাম) বরযাত্রী নিয়ে কনে পক্ষের বিয়ের মঞ্চে উপবিষ্ট। জুমআর সালাতের কার্যক্রম শুরু। কনে পক্ষের বাড়ির নিকটেই মসজিদ। কনে পক্ষ এবং বরপক্ষের অনেকে জুমআর সালাতের জন্য মসজিদে গেলেন আবার অনেকে যেতে পারলেন না যারা সরাসরি বিয়ের আয়োজনের সাথে জড়িত। এমনকি বরও নিজের শেরোয়ানি, নাগ্রা, তাজ খুলে অযু করে জুমআর সালাতের জন্য মসজিদে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। মরিয়ম আক্তারের বাড়ি নড়াইল বিয়ের যাত্রী টাঙ্গাইল থেকে আসে। সেটিও শুক্রবারের দিন। বিয়ের আয়োজন দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে কারন বরযাত্রী প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে আবার ফিরে যাবে কনে নিয়ে। কনে পক্ষের বিয়ের আয়োজন করতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। কনে পক্ষের অনেকেই জুমআর সালাত আদায় করতে পারেননি। বরপক্ষের সকলের জন্য এত পথ ভ্রমণ করার পরিকল্পনা মাথায় রেখে সালাত আদায় করা মুশকিল ছিল।
অথচ মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে সালাত এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ দিয়েছেন। আবার জ্বীন এবং মানব জাতিকে তাঁর ইবাদত ব্যতিত আর কোন উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেননি। তিনি ঘোষণা করেছেন ‘আমি জ্বীন এবং মানব জাতিকে শুধু আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ সূরা জারিয়াত-৫৬।
জুমআর দিনের কাজ বর্ননা এবং গুরুত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন।
সূরা আল জুমুআহ:9 – মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।
সুতরাং বড় কোন প্রকল্পের শিডিউল জুমআর দিনে রাখা সঠিক নয়। কেননা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জুমআর যে কল্যাণমূলক কার্যক্রম আছে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে শুধু সালাত, সাওম, নাহার, হজ্জ ইত্যাদি পালন করে আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন করা যায় বিষয়টি এমন নয়। বরং সালাত সম্পন্ন হলে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী অন্যান্য হালাল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে সেটিও আল্লাহর আদেশ পালন করা বা আল্লাহর ইবাদত কেননা আল্লাহ সুবহানাহু সালাত সম্পন্ন করে কাজে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা দেন যেন মুমিনরা সফল হতে পারে।
সূরা আল জুমুআহ:অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
জুমআর কার্যক্রম বাদ দিয়ে অধিক সফলতার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়া কৌতুক ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে পড়তে আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তিনি জানিয়েছেন আল্লাহর বিধানাবলী পালনের মধ্যেই অধিক সফলতা।
সূরা আল জুমুআহ: তারা যখন কোন ব্যবসায়ের সুযোগ অথবা ক্রীড়াকৌতুক দেখে তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে তারা সেদিকে ছুটে যায়। বলুনঃ আল্লাহর কাছে যা আছে, তা ক্রীড়াকৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সর্বোত্তম রিযিকদাতা।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বিভিন্ন জাতির বিশেষ ইবাদতের জন্য বিশেষ তারিখ নির্ধারণ করেছেন যেমন ঈদূল আদহা, ঈদূল ফিতর, লাইলাতুল কদর ইত্যাদি। অন্যদিকে বিশেষ ইবাদতের বিভিন্ন দিন ও উল্লেখ করেছেন যেমন হযরত দাউদ আলাইহি সালাম এর উম্মাহর জন্য ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবারের দিন বিশেষ ইবাদতের দিন ধার্য করা হয়েছিল এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মাহর জন্য বিশেষ ইবাদতের দিন হলো ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবার।
আল্লাহর বিধান অমান্য করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির ধ্বংস হয়েছে। দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মাহর একটি অংশ ইবাদতের দিন আল্লাহর বিধান অমান্য করে মাছ ধরার কাজে লিপ্ত হওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাদের অভিশপ্ত বানরে পরিনত করেন।
সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানে আল্লাহর বিধান অমান্য করেও জুমআর গুরুত্বকে ছোট করে ঐদিন বিবাহ বা অন্যান্য বিশেষ কোনো কার্যক্রম করার জন্য হয়তো পরম করুনাময় মহান তায়ালা আমাদের দাউদ আ. এর উম্মাহর ন্যায় অভিশপ্ত বানরের মতো কোনো প্রাণী বানাননি। তবে হতে পারে আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের যে অনিষ্ট, অনাচার, কলহবিবাদ, অপশাসন ইত্যাদি আল্লাহর বিধান লংঘনেরই ফল।
দাউদ আ. এর উম্মাহ আল্লাহর বিধান লংঘনের জন্য আল্লাহ তাদেরকে অভিশপ্ত করেছিলেন সেটি পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে নাযিল করেছেন।
সূরা আল বাক্বারাহ: – তোমরা তাদেরকে ভালরূপে জেনেছ, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘণ করেছিল। আমি বলেছিলাম তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।
হযরত মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে আমাদেরকে অভিশপ্ত বানর হওয়ার ঘটনা ছাড়াও অসংখ্য ঘটনা মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা জানিয়েছেন যেন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
সূরা আল বাক্বারাহ: অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ ভীরুদের জন্য উপদেশ গ্রহণের উপাদান করে দিয়েছি।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কোন বিধানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। অর্থাৎ মুমিনদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, রাষ্ট্রীয় সকল কাজ হতে হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সেটির জন্য রয়েছে সফলতা আর তার ব্যত্যয় করলে পাপাচারীর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
সূরা আল মায়েদাহ: ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন। তদানুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী।
যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলেনা তারা শুধু বিভিন্ন অকল্যানের সম্মুখীন হয়না বরং মর্যাদাহীন, অসফল হয়ে ধ্বংস হয়।
সূরা আল মায়েদাহ: বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি, তাদের মধ্যে কার মন্দ প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধাম্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন এবং যারা শয়তানের আরাধনা করেছে, তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকেও অনেক দূরে।
আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির কিছু পাপাচারীকে তার বিধান লংঘনের জন্য অভিশপ্ত বানরে পরিনত করেছেন সেটি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন আয়াতে বর্ননা করেছেন।
সূরা আল আ’রাফ: তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।
আল্লাহ তাআলা তার প্রদত্ত শাস্তি কেমন সে সম্পর্কে যারা জ্ঞাত তাদের নিকট থেকে অজ্ঞাতদের জেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
সূরা আল আ’রাফ: আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর যা ছিল নদীর তীরে অবস্থিত। যখন শনিবার দিনের নির্দেশের ব্যাপারে সীমাতিক্রম করতে লাগল, যখন আসতে লাগল মাছগুলো তাদের কাছে শনিবার দিন পানির উপর, আর যেদিন শনিবার হত না, আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। কারণ, তারা ছিল নাফরমান।
বনী ইসরাইলীরা ছিল খুবই ধুরন্ধর আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বনী ইসরাইলীদের কাছে তাঁর মহান বিধান প্রতিপালনের প্রতিশ্রুতি নেওয়ার জন্য তূর পর্বত তাদের মাথার উপর তুলে ধরেছিলেন এবং দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নেওয়ার পরও তারা শনিবারের দিন মাছ ধরে সীমা লংঘন করে অভিশপ্ত বানরের পরিনত হয়।
সূরা আন নিসা: আর তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেবার উদ্দেশ্যে আমি তাদের উপর তূর পর্বতকে তুলে ধরেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম, অবনত মস্তকে দরজায় ঢোক। আর বলেছিলাম, শনিবার দিন সীমালংঘন করো না। এভাবে তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।
উল্লেখ্য হযরত মুহাম্মদ সা. এর উম্মাহর বিশেষ ইবাদতের দিন যেমন ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবার তেমন দাউদ আ. এর উম্মাহর বিশেষ ইবাদতের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবার নির্ধারণ করেছেন। ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবারে নদীর তীরে মাছ আসত আর বনী ইসরাইলীরা সেই মাছ শিকার করত। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা শনিবারের দিন মাছ শিকার করা হারাম করেন। কিন্তু বনী ইসরাইলীরা শনিবারে সরাসরি মাছ না ধরে বিশেষ জালের মাধ্যমে আটকে রেখে ইয়াওমুল আহাদ বা রবিবার দিন মাছ শিকার করতে লাগলো। তাদেরকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বললে তারা বলত আমরাতো ইয়াওমুস সাবতি মাছ শিকার করিনা বরং ইয়াওমুল আহাদ বা রবিবার দিন মাছ শিকার করি।
পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাইলীদের এহেন হঠকারিতার জন্য তাদেরকে অভিশপ্ত বানরে পরিনত করেন।
৯৫% মুসলিমের দেশে শুধু উবেল, মরিয়ম নয় প্রায় ১০০ ভাগ বিয়ে সম্পন্ন বা অন্যান্য বিশেষ কার্যক্রম হয় পবিত্র ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবারে। কারন তারা অজ্ঞতার কারণে মনে করে এটি একটি পবিত্র দিন তাই এদিনে কোন কাজ করলে বেশি সওয়াব বা বরকতময় হবে। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা এদিন টিকে বিশেষ ইবাদতের জন্য ধার্য করেছেন।
শুক্রবার আমাদের দেশে সরকারি ছুটির দিন হওয়ার কারণেও সমাজের মানুষ এদিন টিকে বেছে নেন। যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ইয়াওমুল জুমআকে আমাদের বিশেষ ইবাদতের দিন হিসাবে ধার্য করে দিয়েছেন তাই এদিন টিকে বিশেষ ইবাদতের দিন হিসাবে পালন করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আমরা সপ্তাহের অন্য যেকোনো দিন করতে পারব ইনশাল্লাহ। কেননা আল্লাহর প্রতিটি দিন ই পবিত্র। অন্যদিকে সরকারি ছুটির বিষয়ে চিন্তা করলে ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবারের দিনও বর্তমান আমাদের দেশে সরকারি ছুটির দিন। সেদিনও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারি।
সুতরাং বিবাহ বা বিশেষ কার্যক্রমের বিষয়ে ইয়াওমুস সাবতি বা শনিবারের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবারে না করে আমাদের অন্যান্য দিনে করা আবশ্যক।
এমফিল গবেষক(এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়