ময়মনসিংহের ত্রিশালে সংঘটিত ট্রিপল মার্ডারের আসামী গ্রেফতার-জেলা পুলিশের প্রেস ব্রিফিং
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ময়নসিংহের ত্রিশালে চাঞ্চল্যকর ট্রিপুল মার্ডারের রহস্য উদঘাটন ও মূল আসামীকে ময়মনসিংহ ডিবি পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে।এ নিয়ে পুলিশ সুপারের সন্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিং আজ দুপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিং বলা হয়েছে গত২১ শে মে দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানাধীন কাকচর নয়াপাড়া সাকিনস্থ প্রবাসী জনৈক কামরুল হাসান এর চাষের জমির আইলের পাশে মাংস বিহীন হাড় মাটির উপর পড়ে থাকা সংক্রান্ত সংবাদের ভিত্তিতে ত্রিশাল থানার অফিসার ইনচার্জ এর নেতৃত্বে ত্রিশাল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে মোট ৩ টি অর্ধগলিত, পোকায় খাওয়া লাশের মধ্যে ০২ টি শিশুর লাশ ধান ক্ষেতের উপর এবং ০১ টি লাশ আইলের পাশে মাটিতে পুতে রাখা অবস্থায় দেখতে পান।মাটিতে পুতে রাখা লাশ উত্তোলন করে একটি মহিলার অর্ধগলিত লাশ সনাক্ত হলেও পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি।
থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশে অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই, সিআইডি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রযুক্তির সহায়তায় লাশের পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করেন কিন্তু লাশগুলো অর্ধগলিত হওয়ায় এবং শিশু বাচ্চা দুইটির লাশ মস্তক বিহীন হওয়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং এর মাধ্যমে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।পরবর্তীতে ঘটনাস্থলেই লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতসহ আনুসাঙ্গিক অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করে ময়না তদন্ত ও ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহের নিমিত্তে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রেরনের জন্য লাশগুলো ত্রিশাল থানায় নিয়ে আসা হয়।পরবর্তীতে ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন থানায় এসে ভিকটিমদের পড়নের কাপড়-চোপড় এবং অন্যন্যা বৈশিষ্ট দেখে পরিচয় সনাক্ত করেন। সনাক্তকৃত পরিচয় থেকে জানা যায় তিনটি লাশ যথাক্রমে আমেনা খাতুন(২৫), স্বামী- আলী হোসেন , আবু বক্কর সিদ্দিকি (৪) ও আনাছ (২বছর ৬ মাস),উভয় পিতা-আলী হোসেন, সাং-কাকচর নয়াপাড়া, ইউপি-রামপুর, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহ। সনাক্তকৃত লাশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক হল মা এবং সন্তান।
ভিকটিমের পরিবারসূত্রে জানা যায়, ভিকটিমের পরিবার আমেনা খাতুন কিংবা তার স্বামী আলী হোসেনের সাথে গত বৃহস্পতিবারের পর থেকে মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে আলী হোসেন এর নিজ বাড়ীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, আলী হোসেন ঢাকার উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গত শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।তারপর থেকে আলী হোসেন পলাতক। ভিকটিম আমেনা খাতুনের মা মোছাঃ হাসিনা খাতুন (৬৫), স্বামী-মোঃ আঃ খালেক, সাং-বাবুপুর, ইউপি-সাখুয়া, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহ তার মেয়ের জামাই আলী হোসনে (৩৫), পিতা-মোঃ আব্দুল হামিদ, সাং-কাকচর নয়াপাড়া, ইউপি-রামপুর, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহসহ অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় অভিযোগ দায়ের করলে ত্রিশাল থানার মামলা নং-২৩, তারিখ-২২/০৫/২০২৪ ধারা-৩০২/৩০১/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০ রুজু করা হয়।মামলা দায়ের পর ময়মনসিংহ জেলার ডিবি পুলিশের একটি চৌকসটিম ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আসামী গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামেন। তথ্য প্রযুুক্তি ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে উক্ত হত্যাকান্ডের মূল হোতা ভিকটিমের স্বামী আলী হোসেনকে গত ২২/০৫/২০২৪ তারিখ গাজীপুরের শ্রীপুর থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন।ধৃত আসামী আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক র্বণনা প্রদান করেন।হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রেক্ষাপট হল ধৃত আসামী দিন মজুরের কাজ করত।তার কোন জমিজমা ছিল না।
অভাবের সংসারে স্ত্রী আমেনা খাতুন এবং দুই ছেলে ছিল। বড় ছেলের নাম আবু বক্কর সিদ্দিক (৪) ও ছোট ছেলে আনাছ( ২ বছর ৬ মাস)।সে তার চাচার দেওয়া জমিতে অনেক দিন ধরে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। সংসারে সারা বছর অভাব অনটন লেগেই থাকত। ঠিকমত তার সংসার চালাতে পারত না।তাই সে বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ভিকটিম আমেনার নাম দিয়ে এনজিও থেকে টাকা তুলত। বেশ কিছুদিন পূর্বে সে এনজিও থেকে ১,৭০,০০০/-টাকা ঋণ নেয়। সেই টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় তাকে এবং তার স্ত্রীকে অপমান করা হত। প্রায়ই তার ছেলে ও বৌ না খেয়ে দিন কাটাত।ঋণের বোঝা, মানুষের অপমান, সংসারের অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে ২/৩ মাস পূর্বেই আলী হোসেন সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রী ও সন্তানদ্বয়কে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করবে।পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আসামী আলী হোসেন গত ১৭/০৫/২০২৪ তারিখ শুক্রবার রাত অনুমান ২ টায় তার স্ত্রী ও সন্তান ঘরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী আমেনা খাতুনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে।
তার স্ত্রী আমেনা খাতুন বিছানা থেকে নেমে ঘরের মেঝেতে গিয়ে বসলে আলী হোসেন তার পিঠের পিঁছনে গিয়ে তার গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে আমেনা খাতুন এর গলায় পেচিয়ে মাটিতে ফেলে দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারপর বিছানায় আসামী আলী হোসেন এর দুই ছেলে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রীর গলা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে প্রথমে ছোট ছেলে আনাছ এর গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং পরপরই তার বড় ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকি এর গলায় ওড়নার বাকী অংশ দিয়ে পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।পরে আসামী আলী হোসেন স্ত্রীকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘরের পিঁছন দিয়ে জঙ্গলে নিয়ে রাখেন এবং এর পরপরই তার দুই ছেলেকেও কোলে করে ওই জঙ্গলে নিয়ে আসে।তারপর জনৈক ইউসুফ ও কালামের জমির মাঝখানে সীমানা বরাবর মাটিতে গর্ত করে তার স্ত্রী ও তার ২ সন্তানকে পুতে রাখে।
ভোরের দিকে সেখান থেকে চলে এসে আসামী ঘরে ঘুমিয়ে পরে। আসামী আলী হোসেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আনুমানিক সকাল ১০ টায় বাড়ী হতে হরিরামপুর এলাকায় চলে যায় এবং বিকালে বাড়ীতে ফিরে এসে মালামাল নিয়ে গফরগাঁও মশাখালী ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে কমলাপুর রেল ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে।ডিবির হাতে গ্রেফতারের আগে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় গোপনে ছিল।উল্লেখ্য একই আসামীর বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় ২০১২ সালে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় একটি মামলায় ৫ বছর কারাভোগ করে ২০১৭ সালে আগস্ট মাসে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।