টিটিই মিঠুর আন্তরিকতায় চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ রোগীর সেবায় ছুটলেন সবাই
স্টাফ রিপোর্টার, পাবনা:
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নীলফামারীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্ত:নগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। কয়েকটি স্টেশন পার হওয়ার পর হঠাৎ করেই চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক কিশোরী। প্রচণ্ড কোমর ব্যথায় বমি শুরু করেন। হাত-পা অবশ হয়ে মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
তার এমন অবস্থায় সাথে থাকা মেয়েটির চাচা-চাচি পাগল প্রায়। পরে মেয়েটির চাচা সহযোগিতা চাইলেন ট্রেনের টিটিই’র কাছে। সেই টিটিই’র আন্তরিকতা আর চেষ্টায় ট্রেনে থাকা কয়েকজন চিকিৎসক আর নার্স মিলে সুস্থ করে তুললেন মুমূর্ষু সেই কিশোরীকে।
এমনই এক মানবিক ঘটনা ঘটেছে সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকা-সৈয়দপুরগামী চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ কিশোরীর চিকিৎসায় যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে গেছেন সবাই।
অসুস্থ্য সেই কিশোরীর নাম সুমনা আক্তার (১৯)। তিনি নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব চেংমারি গ্রামের মোক্তাহারুল ইসলামের মেয়ে। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছেন সুমনা।
সুমনার চাচা মশিউর রহমান জানান, ‘পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঢাকায় আমার বাসায় বেড়াতে আসে আমার ভাতিজি সুমনা আক্তার। মাস খানেক থাকার পর সোমবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে চিলাহাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্ত:নগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস। ট্রেনের জ বগিতে ছিলাম আমরা। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর কোমড় ব্যথায় কাতরাতে থাকে সুমনা। ধীরে ধীরে ব্যাথা প্রচন্ড আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল, বমি করছিল। আবার মূর্ছাও যাচ্ছিল।’
ট্রেনের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘ট্রেনের পেছনের প্রান্তে টিকিট চেকিং করছিলাম। মৌচাক স্টেশন পার হওয়ার পর জ কোচের মাঝখানের একজন যাত্রী মশিউর রহমান আমার কাছে সহযোগিতা চাইলেন তার ভাতিজি ভীষণ অসুস্থ। তিনি ব্যথার ওষুধ চাইলেন। তখন ট্রেনে আমাদের কাছে ব্যথার ওষুধ ছিল না। আমি টাঙ্গাইল স্টেশনে ফোন দিলাম। তারা জানালো ঔষধের দোকান স্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। তাই সম্ভব নয়।’
‘মেয়েটির চাচা মশিউর রহমান আমাদের কাছে ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কিনা সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে বললেন। আমি তৎক্ষণাৎ যাত্রী সাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করে উচ্চস্বরে নিজ মুখেই ঘোষণা করি যে, ‘একজন মেয়ে যাত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ডাক্তার থাকেন, তবে আপনার মানবিক সাহায্য কামনা করছি। তখন একজন যাত্রী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসেন। আমি তাকে সাথে সাথে রোগীর কাছে নিয়ে যাই। তিনি রোগীর চাচা-চাচি এবং রোগীর সাথে কথা বলে তার সমস্যা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন।’
ইতিমধ্যে ট্রেনের পিএ অপারেটরের ঘোষণা শুরু আরো দু’জন ডাক্তার এবং একজন নার্স সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনজন ডাক্তার মিলে তাকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। রোগীর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে তারা রোগীকে কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে বলেন। কিন্তু রোগী যাবেন না, অথচ প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন। এরপর ডাক্তাররা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কিছু ঔষধের চাহিদা দিলেন।’
আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রেলওয়ে স্টেশনে ঔষধ সংগ্রহের বিষয়ে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু তারা জানালো সেখান থেকে ফার্মেসি অনেক দুরে, তাই ওষুধ পাওয়া সম্ভব নয়। আমি আবার ট্রেনের ভেতরেই কোন যাত্রীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ঔষধ আছে কিনা তার ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে পিএ অপারেটর ব্যবস্থায় ঘোষণা দিতে বললাম। ঘোষণা শুনে কয়েকজন যাত্রী যার কাছে যে ঔষধ ছিল তা নিয়ে হাজির। প্রেশার মাপার যন্ত্রের ব্যাপারে ঘোষণা দিলে সেটা নিয়েও একজন হাজির। প্রেশার মাপা হল। প্রেশারের ঔষধেরও প্রয়োজন হলো। কেউ নিয়ে এলেন ব্যথার ঔষধ, কেউ প্রেশারের। তারপর ডাক্তাররা গরম পানির ছেক দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। ক্যান্টিন থেকে বোতলে দ্রুত গরম পানির ছেক দেবার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু রোগীর যে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।’
টিটিই মিঠু বলেন, ‘এরপর ডাক্তাররা ব্যথানাশক সাপোজিটরির ব্যবস্থা করতে বললেন। এবার আমি নিজে সেতু পূর্ব রেলওয়ে স্টেশনে ঘোষণা দিয়ে কোন যাত্রীর কাছে সাপোজিটরি থাকলে সহযোগিতা চাইলাম। কিন্তু, ব্যথানাশক ট্যাবলেট থাকলেও কারো কাছে সেটা ছিল না। তিনজন ডাক্তারই রোগীর সামনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। রোগীর চাচা জানালেন, বড়ালব্রিজ স্টেশন এলাকায় তাদের পরিচিত লোক আছেন। তিনি তাকে ঔষধের প্রয়োজনের ব্যাপারে বললেন। কিন্তু বড়ালব্রিজ স্টেশনে চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ নাই। আবার রোগীর অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে।
আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘এমতাবস্থায় আমি ট্রেনের পরিচালককে অনুরোধ করলাম যদি একটু ট্রেনটি ধীরগতিতে করা যায় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক জরুরি ঔষধগুলো সংগ্রহ করা যাবে। ট্রেন পরিচালক রাজি হলে আমরা ঔষধের ব্যবস্থা করতে বললাম। বড়ালব্রিজের বুকিং সহকারী মামুন ভাইকে ঔষুধ নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে সাহায্য করতে বললাম এবং আমি বড়ালব্রিজ স্টেশনে ঔষধগুলো নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের হাতে বুঝিয়ে দিলাম। দেখলাম যে, আগের গ্রহণ করা ঔষধের দ্বারা মেয়েটি কিছুটা ভালো বোধ করছেন। তারপরেও ডাক্তাররা তাদের চাচিকে ঔষধগুলো ব্যবহারের ব্যাপারে বুঝিয়ে বললেন।’
প্রতিক্রিয়ায় আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘ট্রেনে এমন অনেক মানবিক ঘটনা ঘটে। অনেকে নানা রকম সমস্যায় পড়েন। আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। মেয়েটির অসুস্থতার বিষয়টিও তেমনি একটি ঘটনা। তবে ভাল লাগার ব্যাপার হলো মানুষের মধ্যে মানবিক মুল্যবোধ, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা অনেকের মাঝে আছে। এমন কাজ করতে পেরে নিজের কাছে অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করে।’
সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, ‘ট্রেনের টিটিই থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন তাতে আমি সত্যি মুগ্ধ। তাছাড়া আমার ভাতিজির যে অবস্থা ছিল তা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রাথমিক চিকিৎসায় সে সুস্থবোধ করে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে যে কেমন অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগীরা জানে। আর এভাবেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সবার প্রতি আমাদের ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানাই।’
মেয়েটির চিকিৎসায় সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত ডা. মো. ফাহিম উদ্দিন, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. মো. শামসুল ইসলাম ও ডা. মো. নাজমুল হুদা। তাদের সাথে বিভিন্নভাবে সহযোগিতায় ছিলেন একজন নার্স (নাম জানা যায়নি), চিলাহাটি এক্সপ্রেসের পরিচালক বিশ্বজিৎ রায়, টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু, টিটিই আমিরুল হক জাহেদী, এসি অপারেটর দীন ইসলাম, সৈয়দপুর জিআরপি থানার ইনচার্জ ফজলুল হক, ক্যান্টিন বয় রাকিবুল ইসলাম।
১০০ শয্যা বিশিষ্ট সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে আমরা তিনজন ডাক্তার ছুটে যাই। আসলে আমরা ডাক্তাররা তো সেবার জন্য কাজ করি। সেইজন্য আমরা দায়িত্ববোধ থেকে মেয়েটির চিকিৎসা এগিয়ে গিয়েছি। এছাড়া আমরা যখন যেটা চেয়েছি মেয়েটির চিকিৎসার জন্য মানুষ তাৎক্ষণিক যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় ছুটে এসেছে। এটি ভাল দিক। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ একটু বেশি মানবিক, আন্তরিক।’
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে এই একই ট্রেনের (চিলাহাটি এক্সপ্রেস) ঘ নম্বর বগিতে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাবার পথে চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক অন্ত:স্বত্ত্বা নারী। শুরু হয় রক্তপাত। ট্রেনের লাউড স্পিকারে ঘোষণা দিয়ে চিকিৎসকের খোঁজ করা হয়। ঘোষণা শুনে একজন শিক্ষানবিস চিকিৎসক ও দু’জন নার্স ছুটে আসেন। নারী যাত্রীরা তাদের কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখেন স্থানটি। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনের তিন চেয়ারের একটি আসন অস্ত্রোপচার কক্ষ হয়ে ওঠে। তবে, ওই নারীর মৃত সন্তান প্রসব হলেও, প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এ ঘটনা ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।