দার্শনিক ও সাহিত্যিক জঁ-পল সার্ত্র সমাজবিজ্ঞান ও বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |
ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক জঁ-পল সার্ত্রের ১১৮তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি সমাজবিজ্ঞান ও বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এছাড়াও তার কাজের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যতত্ত্ব, উত্তর উপনিবেশবাদি তত্ত্ব ও সাহিত্য গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ফরাসী লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়ারের সাথে সার্ত্রর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল; তারা পরস্পর বন্ধনহীন প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন।
জঁ-পল সার্ত্র ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন তবে এই পুরস্কার গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান; কারণ তার মতে একজন লেখককে কখনই নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া উচিত নয়।
শিক্ষা
সার্ত্রের প্রথম জীবনের দশ বছর কাটে পিতামহ মসিয়েঁ শার্ল শোয়াইটজারের তত্ত্বাবধানে। বলা চলে এ অবস্থায় সার্ত্র স্বাধীনভাবেই বেড়ে উঠছিলেন। শৈশবে তিনি তার মাতামহের বিশাল গ্রন্থাগারের প্রায় সব পুস্তকই পড়ে ফেলেছিলেন। ১৯৫২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট সোয়াইৎজার ভ্রাতুষ্পুত্রী এনিমারি তাঁর মা। শৈশবে একটি বড় সময় কেটেছে যাদের সঙ্গে সেই মা এনিমারি এবং পিতামহ চার্লস শোয়েটজারের প্রভাবকেই জীবনে বড় বলে মেনেছেন সার্ত্রে। যদিও সার্ত্রে’র বয়স যখন নয় তখন দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মায়ের সাথেও খানিকটা দূরত্ব বাড়ে তার। স্কুল এবং কলেজের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সার্ত্রে’র আচরণে অনিশ্চয়তা এবং জেদের বিষয়গুলোও স্পষ্ট হতে থাকে। এরপর ১৯২৫ সালে তিনি ভর্তি হন ‘ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের সূতিকাগার’ বলে কথিত ‘ইকোলে নরমাল সুপিরিয়র’-এ। পরীক্ষায় প্রথমবার অকৃতকার্য হলেও, দ্বিতীয়বারে ১৯২৯ সালে কৃতকার্য হন।
অধ্যাপনা ও দর্শনচিন্তা:
প্যারিসের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একোলি নরমাল সুপেরিয়ের থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ও ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সাথে তার আলাপ হয়। ক্রমে কেন্ট, হেগেল এবং হেইডেগারের মতো দার্শনিকদের তত্ত্ব অধ্যয়ন করেন তিনি। এরই মাঝে ১৯২৯ সালে সার্ত্রের পরিচয় ঘটে সেই সময়কার আরেক আলোচিত লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ার সঙ্গে, যার সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি চমৎকার সম্পর্ক বজায় ছিল সার্ত্রে’র। ১৯৩১ সালে দর্শনের প্রফেসর হিসেবে লা হার্ভেতে যোগ দেন সার্ত্রে। ১৯৩২ সালে বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে দর্শনশাস্ত্রের ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্যে যান। এ সময় সমকালীন ইউরোপের অনেক বড়মাপের দার্শনিকদের সাথেও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয় তার। তিনি ১৯৩৫ সালে প্যারিসের লিসে কঁদরসে শিক্ষকতা শুরু করেন পাশাপাশি এডমুন্ড হুসরল ও মার্টিন হাইত্তোগার-এর কাছে দর্শনশাস্ত্র পাঠ করতে থাকেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন একজন ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে। তিনি নাৎসি পার্টির হাতে বন্দীও হন। জার্মানদের কাছে যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থাতেই রচনা করেন তার প্রথম নাটক। যদিও অসুস্থতার কারণে বন্দি হবার বছরখানেকের মাথাতেই সার্ত্রেকে মুক্তি দেয় নাজি বাহিনী। যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তার পর্যবেক্ষিত বাস্তবতা গভীর ছাপ ফেলে তার মনে। এ সময় প্যারিসে ফিরে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপে (নাৎসী বিরোধী দলে)র সাথেও নিজেকে যুক্ত করেন সার্ত্রে। সেই সাথে চলে লেখালিখিও। ১৯৪৪ সালে প্যারিসে যুদ্ধাবসানের সময়কালে তিনি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন যা উচ্চ প্রশংসিত হয় এবং সার্ত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই পাশ্চাত্য জগতের এ দার্শনিক চিন্তানায়ক সারাবিশ্বে খ্যাতির শিখরে ওঠেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ল’ ত্রে এত্ল্য নিয়াত বা বিং এন্ড নাথিংনেস প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। এরপর তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ ‘লেস্ শেমিনস্ দ্য লা লিবার্তে’ তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। সার্ত্রের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ‘ক্রিতিক দ্য লা রেসঁ দিয়া লেক্তিক’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৭১ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্লরেয়ার’ প্রকাশিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতি:
নানাসময়ে তার লেখনীতে খুঁজে পাওয়া যায় সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন। এছাড়া নিজের স্বতন্ত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক বিশ্বাস ও স্পষ্ট ভাষণের কারণে নানাসময়ে বহু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে সার্ত্রেকে। এমনকি আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন এবং আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের কট্টর সমালোচক ছিলেন সার্ত্রে। এই কারনে তার ফ্ল্যাটে বোমা ছোঁড়া হয়। বহুবারই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন সার্ত্রে। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে বেশ কয়েকবার।
বিশ্বজোড়া সাহিত্য খ্যাতি:
যে লেখাগুলি সার্ত্রেকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তার মধ্যে রয়েছে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হওয়া সার্ত্রে’র প্রথম উপন্যাস ‘লা নাজি’, ‘দ্য মুর’, ‘ব্যারিওনা’ (প্রথম নাটক), ‘দ্য ফ্লাইজ’, ‘নো এক্সিট’, ‘দ্য এজ অব রিজন’, ‘দ্য রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট’, ‘দ্য ভিক্টরস’, ‘দ্য চিপস্ আর ডাউন’, ‘ইন দ্য ম্যাস’, ‘ডার্টি হ্যান্ডস’, ‘ট্রাবলড পি’, ‘দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড’, ‘কিন’, ‘দ্য কনডেমড অব আলটোনা’, দ্য ট্রোজান ওম্যান’, ‘দ্য ফ্রড সিনারিও’ প্রভৃতি। মূলত উল্লিখিত এ সবগুলোই ছিল সার্ত্রে’র লেখা উপন্যাস, নাটক ও ছোটগল্পের তালিকা। আর এসবের বাইরে দার্শনিক যেসব প্রবন্ধ ও সমালোচনা দিয়ে সার্ত্রে নজর কাড়েন তার মধ্যে রয়েছে ‘ইমেজিনেশন : এ সাইকোলজিক্যাল ক্রিটিক’, ‘দ্য ট্রানসেন্ডেন্স অব দ্য ইগো’, ‘স্কেচ ফর এ থিওরি অব দ্য ইমোশন্স’, ‘দ্য ইমেজিনারি’, ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’, ‘এক্সিসটেনসিয়ালিজম ইজ এ হিউম্যানিজম’, ‘সার্চ ফর এ মেথড’, ‘ক্রিটিক অব ডায়ালেকটিক্যাল রিজন’, ‘এন্টি সেমাইট অ্যান্ড জিউ’, ‘বদলেয়ার’, সিচুয়েশন সিরিজ (ওয়ান টু টেন), ‘ব্ল্যাক অরফিউজ’, ‘দ্য হেনরি মার্টিন অ্যাফেয়ার’ প্রভৃতি। এছাড়া সার্ত্রে’র লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সার্ত্রে বাই হিমসেল্ফ’, ‘দ্য ওয়ার্ডস’, ‘উইটনেস টু মাই লাইফ কোয়াইট মোমেন্টস ইন এ ওয়ার’ এবং ‘ওয়ার ডায়েরি’স’। সার্ত্রে ও বোভেয়া’র মিলে ‘লেস ভেজপস মোদারনেস’ নামক মাসিক পত্রিকা বের করতেন। এ পত্রিকাটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তাঁর বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন নি।
পুনশ্চ : তিনি ছিলেন অস্তিত্ববাদ ও প্রপঁচবিজ্ঞানের দর্শনে একজন পথিকৃৎ ও বিংশ শতকের ফরাসি দর্শন ও মার্কসবাদের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক এবং সাহিত্য সমালোচক।
জঁ-পল চার্লস এইমার সার্ত্রের জন্ম: ২১ জুন ১৯০৫ (প্যারিস, ফ্রান্স)। যুগ: বিংশ শতাব্দীর দর্শন। অঞ্চল: পাশ্চাত্য দর্শন। ধারা: মহাদেশীয় দর্শন, অস্তিত্ববাদ, প্রপঁচবিজ্ঞান, মার্কসবাদ ও নৈরাজ্যবাদ। আগ্রহ: অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য ও রাজনৈতিক দর্শন। অবদান: Bad faith, “existence precedes essence,” nothingness, “every consciousness is a non-positional consciousness of itself,” situation, Sartrean terminology.
ভাবগুরু: Aron, Camus, de Beauvoir, Flaubert, Freud, Hegel, Heidegger, Husserl, Kierkegaard, Kojève, Mao, Marx, Merleau-Ponty, Nietzsche, Nizan, Rousseau.
ভাবশিষ্য: Raymond Aron, Albert Camus, de Beauvoir, Frantz Fanon, Michel Foucault, Che Guevara, R. D. Laing, Maurice Merleau-Ponty.
মৃত্যু:
ফুসফুস সংক্রান্ত জটিলতা এবং শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে প্যারিসে মারা যান সাহিত্যিক, দার্শনিক ও চিন্তানায়ক জ্যঁ পল সার্ত্র।
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)
২১ জুন ২০২৩# #
তথ্য সূত্র :
১. “Sartre’s Debt to Rousseau”
২. এই ফরাসি ব্যক্তিনামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপিডিয়া:বাংলা ভাষায় ফরাসি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ-এ ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
৩. The Nobel Foundation (1964).”Minnen, bara minnen” আইএসবিএন ৯১০০৫৭১৪০৭ from year 2000 by Lars Gyllensten Nobel Prize in Literature 1964 – Press Release. Address by Anders Österling, Member of the Swedish Academy. Retrieved on: 4 February 2012.
৪. শরীফ হারুন, অস্তিত্ববাদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা-৫৪।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * সাহিত্যিক জঁ-পল সার্ত্র
সর্বশেষ সংবাদ