আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির প্রভাবক তুরস্ক এবং এরদোয়ানের ভুমিকা

 

 

২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশে নির্বাচনের বছর। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা রিসেপ তাইপ এরদোয়ান। তুরস্কের নির্বাচনে নজর ছিল সারা বিশ্বের । কারণ বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের খেলায় তুরস্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইদানিংকালে বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্ক অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তুরস্ক প্রভাবক ছিল। গত কয়েক বছর ধরেই তুরস্ক রাজনীতি, সামরিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে। এখানে ভৌগলিকভাবে তুরস্কের অবস্থান গুরুত্ব বহন করে। তুরস্ক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আনাতুলিয়া উপদ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছে। এ কারণেই দেশটি
এশিয়া ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে এশিয়ায় যেমন তুরস্কের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি ইউরোপের ক্ষেত্রেও। তুরস্কও তার ভূমিকার যথাযথ ব্যবহার করে আসছে। বর্তমান সময়টা শুধু তুরস্কের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ না বরং সারা বিশ্বের কাছেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যখন বিশ্ব বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের অধিকাংশই রাজনৈতিক। একদিকে রাশিয়া এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মুহূর্তে উভয় ক্ষমতাধর দেশের সাথেই তুরস্কের বেশ ভারসাম্যের সম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনশীলতার অন্যতম কারণ হলো- চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সামরিক সংঘাত। চলমান সংঘাত বিশ্বে যে বিভক্তির জন্ম দিয়েছে সেই বিভক্তিতে প্রকাশ্যেই কোনো কোনো দেশ পক্ষালম্বন করেছে এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আরও বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। বিপরীতে রাশিয়ার উপর দিয়েছে নিষেধাজ্ঞার বোঝা। এটাও দেশটিকে কাবু করার একটি পন্থা। এর বাইরে কিছু দেশ কোনো পক্ষই সরাসরি সমর্থন করেনি। উপরন্তু যুদ্ধের বিপক্ষে কথা বললেও কোনো সিদ্ধান্তে সামিল হয়নি। অর্থাৎ এখানে ভারসাম্যের নীতিতে চলছে।

বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে তুরস্কে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ফের ক্ষমতায় এসেছেন এরদোয়ান। একটা সময় বিজয়ের পাল্লা দোলাচলেই ছিল।

তুরস্কের জনগণ তার উপরেই ভরসা করেছেন। দেশটিতে ইতিহাসের প্রথমবারে মতো দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে বিজয়ী হন এবং তার গত ২০ বছরের ক্ষমতা আরও পাঁচ বছরের জন্য প্রসারিত হলো। এ নিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট হলেন। কঠিন সময়ে এরদোয়ানকেও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হওয়ার পর অবশেষে বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়। এরপর তার রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন।

২০০৩ সালে এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০১৬ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান তার পক্ষে শাপে বর হয়। তাঁর বর্তমান তুরস্ক বহু চ্যালেঞ্জের মুখে দাড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দেশটির অর্থনীতি। বেশ কয়েক বছর ধরেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার
দর কমছে। তুরস্কের বর্তমান অর্থনীতি বলতে গেলে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি এবং দেশটিতে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি ছিল লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও সবশেষ ভূমিকম্পের ঘটনায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনায় তার জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পরে। তার রেশও পাওয়া যায় প্রথম দফা নির্বাচনে যখন কোনো সমাধান আসে না তখন। গত অক্টোবরে সেখানে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮০ শতাংশ। এপ্রিলে তা নেমে আসে ৪৩ শতাংশে। সেখানে বেড়েছে খাদ্যপণ্য, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য জিনিসের দামও। তার রাজনৈতিক দুরদর্শিতা এবং বিশ্বে তুরস্ককে গুরত্ববহ করে তোলা অর্থাৎ কূটনৈতিক সাফল্যই তাকে আবারও ক্ষমতায় এনেছে কিন্তু এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি ফেরাতে ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা লাঘবে বেশি কাজ করতে হবে। দেশের অর্থনীতির এ দুরাবস্থার পেছনে অনেক অর্থনীতিবিদ এরদোয়ানের নীতির সমালোচনা করেন।

সুতরাং তাকে অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হতে হবে। টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের উপর মানুষের প্রত্যাশার চাপ আগের চেয়েও বেশি থাকবে। তাদের যোগ্য নেতা অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাবেন এমনটাই আশা থাকবে। এর সাথে সাথে বিশ্ব রাজনৈতিক মেরুকরণেও তুরস্কের ভূমিকা কি হব সেটাও দেখার বিষয়। তুরস্ক ন্যাটো জোটভুক্ত সদস্য রাষ্ট্র। তুরস্কের আপত্তির কারণেই সুইডেন ন্যাটোতে আসতে পারছে না। কারণ ন্যাটোর নিয়ম অনুযায়ী, ন্যাটোর সদস্য হতে হলে সদস্য সব রাষ্ট্রের সমর্থন থাকতে হবে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ফিনল্যান্ডের সামনের বাধা দূর হয় এবং ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার পথ সুগম হয়। এখন সুইডেন চেষ্টা করছে। কৌশলগতভাবে ন্যাটো জোট সম্প্রসারণে সুইডেন অপেক্ষায় রয়েছে। বিপরীতে রাশিয়া ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণে নাখোশ। ন্যাটোতে যোগ দেওয়া থামাতেই ইউক্রেনে বর্তমান সামরিক অভিযানের একটি কারণ। বিবিসি বলছে, পশ্চিমারা মনে-প্রাণে চায় তুর্কি অর্থনীতির চলমান সংকট কাটাতে যেন বেশি বেশি দেশি বিদেশি বিনেয়োগ কামনা করেন এরদোয়ান। আর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হয়তো সুইডেনের ন্যাটোভুক্তকরণের শর্ত জুড়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে পশ্চিমারা।অর্থাৎ এখানে হিসাবটা সহজ মনে হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ কঠিন। তুরস্কের এই মুহূর্তে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগও দরকার হবে। এটা যদি পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে পেয়ে থাকে তার বিনিময়ে তুরস্ককে সুইডেনের ব্যাপারে নমনীয় হতে রাজী করাতেও পারে। তবে সেক্ষেত্রে রাশিয়ার বিষয়টিও তুরস্কের মাথায় থাকবে। কারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সুইডেন যদি ন্যাটোর সদস্য হয় তখন দেশটির সংলগ্ন বাল্টিক সাগর দিয়ে রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে পারবে পশ্চিমারা। তুরস্ক হয়তো এখন রাশিয়ার বিরাগভাজন হতে চাইবেন না। সুইডেন ইস্যু নিয়ে বাইডেন- এরদোয়ান ফোনালাপও হয়েছে। অর্থাৎ এরদোয়ানের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমাদের সাথে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকবে সুইডেনের ন্যাটোভুক্তিতে তুরস্কের আপত্তির বিষয়টি। দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মনোযোগী হতে হবে। তাছাড়া রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তুরস্ক গুরুত্বপর্ণূ ভূমিকার রাখতে পারে। তৃতীয় মেয়াদেও জনগণ তার সাথেই রয়েছে। জনগণের আস্থা থাকলে এসব ইস্যু সহজেই মোকাবেলা সম্ভব। সুতরাং রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের সামনে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুরস্ককে আরও উচ্চাতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট-
পাবনা

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির প্রভাবক তুরস্ক * এরদোয়ানের ভুমিকা
সর্বশেষ সংবাদ