ঠাকুরগাঁওয়ে তেল-সারের দাম বাড়ে কিন্তু ধানের দাম বাড়ে না
নাজমুল হোসেন, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ
জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধি ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ বেড়ে গেছে। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে সেচ দেওয়া, খেত পরিচর্যা করা, শ্রমিকের মজুরি সব ক্ষেত্রেই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হচ্ছে কৃষকদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাসায়নিক সারের কৃত্রিম সংকট। কৃষকদের অভিযোগ সারের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি রোধ না করলে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে খরচ উঠবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। ঠাকুরগাঁও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল এ চার উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আশঙ্কার কথা জানা গেল।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার কৃষকরা বোরো ধান রোপনে জমিতে সেচ, জমি প্রস্তুত ও চারা উত্তোলন করে রোপন কাজে ঘামঝড়া পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। কিন্তু বর্তমান দ্রব্যমূল্যের আগুন দামে ডিজেল ও সারের কৃত্রিম সংকটের কারণে ধান উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় হাউহুতাশ খাচ্ছেন তারা।
ঠাকুরগাঁওয়ে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ হাজার ১৫০ হেক্টর জমি। যার ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৪০ মেট্রেক টন। আর এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে ধান রোপন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি জমিগুলোতে আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যেই রোপণ কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) আলমগীর কবিরের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছর বোরো ধানের ক্রয় মূল্য ছিলো ২৬ টাকা কেজি। সেই হিসেবে ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৪০ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা অনুযায়ী এবার ৬৯৬ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে এ জেলায়।
আকচা ইউনিয়নের বন্দর পাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান (৫০) বলেন, ‘সরকার বলছে সারের কোন ঘাটতি নাই কিন্তু বাজারে তাদের নির্ধারিত দামে ঠিক মতো কোন সার পাওয়া যাচ্ছেনা, গেলেও দাম দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ। ইউরিয়া ১২’শ, টিএসপি ১৭’শ ও পটাশ (এমওপি) ১৬’শ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। সরকার যদি আমাদের দিকে না দেখে তাহলে আমরা কৃষক মাঠে মারা যাবো। সরকার চাকুরিজীবীদের বেতন ঠিকই বাড়াচ্ছে কিন্তু কৃষকদের খোঁজ নেন না। আরেক কৃষক আলতাফ বলেন, ডিজেলের দাম যেভাবে সরকার বাড়াইছে, এতে আমাদের বাঁচার কোন পথ দেখি না। ডিজেলের দাম বাড়ে, সারের দাম বাড়ে। কিন্তু বাজারে গেলে ধানের দাম নাই। বাজারের গায়ে তো হাত দেওয়া যায় না। তাইলে বলেন কৃষক কেমনে বাঁচবে?
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ির ইউনিয়নের কৃষক বাবলু বলেন, ‘ডিজেল ও সার-বিষের দামের জন্য আমরা ক্ষেতের ঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারছি না। টাকার অভাবে এতো দামে আমরা তেল, সার-বিষ কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। সরকার যদি এসবের দাম একটু কমায় তাহলে আমাদের কৃষকদের খুব উপকার হবে। রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানায়, যেভাবে ডিজেল ও সারের দাম হুট করেই বেড়ে যায় ঠিক তার উলটোভাবে ফসলের দাম কমে যায়। ফসল বিক্রি করে খরচ তুলে আনায় অনেক কস্ট হয়ে যায় আমদের।
কৃষক হামিদুর রহমান জানায়, নিজের অল্প জমি থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই অন্যের জমি বর্গা নিয়েই চলে তার চাষাবাদ। জ্বালানি তেল ও সারের মূল্যবৃদ্ধির খবর যেন তার কাছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার চেয়েও বেশি কিছু। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সারের পর তেলের দাম বাড়ি গেইছে। বিবি বাচ্চাদের নিয়ে কীভাবে বাঁচবো সেইটায় ভাবছি। এখন যদি সরকার তেল সারের দাম কমায় তাহলে ভালো হইবে।
গড়েয়া ইউনিয়নের ঢাংগী পুকুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, আমি ১০ একর জমিতে এবার বোরো আবাদ করেছি। কিন্তু বর্তমানে কৃষিপণ্যের যে দাম তাতে ৫০ শতকের প্রতি বিঘা জমিতে বোরো আবাদে ২৬ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। যদি ধানের মণ ১৫০০ টাকা থাকে তাহলে হয়তো আমরা একটু লাভবান হবো।
অন্যদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারের কোনো ঘাটতি নেই। জেলায় চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সার মজুদ রয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দামে সার বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।