সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক সোহেল

নিজস্ব প্রতিবেধকঃ
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক সোহেল। সিটি কর্পোরেশনের কর আদায়কারী হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু। অফিসের কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হয়ে চলতি দায়িত্ব পান মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব। এরপর থেকে সিটিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেন সোহেল। সকল ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন।তার কাছে অসহায় সিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও। ইতিমধ্যে সফর করেছেন আমেরিকা সহ কয়েকটি দেশ। ক’বছরের ব্যবধানে বাড়িও বানিয়েছেন সিলেট নগরের মেজরটিলা এলাকায়।
পুরো নাম সোহেল আহমদ। সিলেট সিটি করপোরেশনের তৃতীয় গ্রেডের চাকুরে। বাড়ি সিলেটের গোয়াইনঘাটের গুরুকচি গ্রামে।
২০০৫ সালে গোয়াইনঘাট থেকে সিলেট নগর ভবনে চাকরি নেন। তখন অস্থায়ী ভিত্তিতে তিনি কর ধার্য শাখার আদায়কারী পদে যোগদান করেন। এরপর থেকে কর আদায়কারী শাখাতেই চাকরি করছিলেন। ২০১৩ সালে একই পদে চাকরি স্থায়ী হয় সোহেলের। আসে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে পর পটপরিবর্তন হওয়ায় বদলে যান সোহেল আহমদ। তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ডাক পড়ে মেয়রের দপ্তরেই। সহকারী একান্ত সচিব পদে আসীন হয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, মেয়রের সহকারী হিসেবে প্রথমে অঘোষিত ভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। তখন থেকেই শুরু হয় দাপট।
মেয়রের কাছে নানা কাজে আসা নগরের লোকজনের তার মাধ্যমেই মেয়রের কাছে পৌঁছতে হয়। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে টাকা ইনকামের বিভিন্ন অবৈধ উপায় বের করে নেয়। যারাই মেয়রের কাছে বিভিন্ন কাজে আসেন সোহেল তাদের কাজ করে দেন টাকার বিনিময়ে। সিটি করপোরেশনের দপ্তরে দেন মেয়রের নাম ব্যবহার করেন। মেয়রের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা লুটের মহোৎসব চালান। এতে করে ২০১৮ সালের আগেই কোটিপতি হয়ে যান সোহেল। তখন তিনি নগরীর মেজরটিলা এলাকায় সাড়ে ৩ শতক ভূমি ক্রয় করেন।
এই ভূমি অবশ্য তার নামে নয়। ভাই শামীমের নামে ক্রয় করা। তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে নির্মাণ করেছেন এক তলা ভবন। আরও দু’তলা নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। তবে- সেখানে তিনি বসবাস করেন না। ভাড়া দিয়ে রেখেছেন ওই বাসা। নিজে বসবাস করেন নগরীর কাজিটুলা এলাকায় ভাড়া বাসায়। গত ৫-৬ বছরে সোহেল ভ্রমণ করেছেন সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সহ কয়েকটি দেশে। কখনো কখনো একই বছরে দুইবার ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ পরিবার নিয়ে তিনি আমেরিকা সফর করেছেন।
৩-৪ মাস অবস্থানের পর সম্প্রতি দেশে এসেছেন। কর্মস্থলেও যোগ দিয়েছেন। সহকর্মীরা জানিয়েছেন, সোহেল ফের আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। ওই সময় ট্রেনিং ও সেমিনারে অংশ নিতে তিনি অস্ট্রেলিয়া যান। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তার ভ্রমণের খরচ বহন করা হয়। ওই ভ্রমণে যাওয়ার কথা ছিল মেয়রের। শেষ পর্যন্ত মেয়রের সফর স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। গত কয়েক বছরে সিলেট সিটি করপোরেশনে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কয়েকশ’ কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। সিটি করপোরেশনের লোকবল সংকটের কারণেই সেটি করা হয়েছিল। এই লোকবল নিয়োগে সোহেল প্রভাব খাটিয়েছেন একতরফা।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোহেলের মাধ্যমে কয়েক বছরে অন্তত ২৫-৩০ জন কর্মচারী দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনে চাকরি নেন। তাদের প্রত্যেককেই চাকরি পেতে সোহেলকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেন। আর এই টাকা একাই হাতিয়ে নেন সোহেল। মেয়রের লোক পরিচয় দিয়ে তাদেরকে চাকরি পাইয়ে দেন তিনি। এই নিয়োগের অনেক বিষয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর অজানা বলে জানিয়েছেন তারা। এর মধ্যে কয়েকজন নিকট আত্মীয়ও রয়েছে সোহেলের। নিয়োগকৃত কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে কর আদায়কারী মারুফ, বস্তি উন্নয়নে নোমান, এসএস’র মোজাক্কির সহ কয়েকজন। সিলেট সিটি করপোরেশনে গত তিন বছরে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন সহ বড় পরিসরে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
প্রতি আয়োজনে সোহেল ছিলেন সম্পৃক্ত। মেয়রের প্রতিনিধি হিসেবে তার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এসব অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে অনেক টাকা কামাই করেন তিনি। অনুষ্ঠান আয়োজনে তিনি যে হিসাব দাখিল করেছেন সেগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, অনেক সময় হিসেবে গরমিল থাকলেও মেয়রের দোহাই দিয়ে সেগুলো পাস করিয়ে নেয়া হয়। আর সোহেলের দাপটের কাছে সবাই অসহায় থাকায় কেও প্রতিবাদ করেনি। সম্প্রতি নগর ভবনের একটি তদন্ত কমিটিতেও মেয়রের প্রতিনিধি হিসেবে সোহেলকে রাখা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের সবাই জানেন সোহেল গত এক বছর ধরে সিটি করপোরেশনের পরিবহন শাখার একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। নতুন কেনা ডাবল কেমি পিকআপ গাড়িটি তার নামেই বরাদ্দ। তিনি সেটি ব্যবহার করেন। দৈনিক মজুরিভিত্তিতে একজন চালকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে গাড়ি চালানোর জন্য। তেলের খরচ বহন করা হয় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে। গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে পরিবহন শাখার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে সোহেল এই গাড়ি ব্যবহার করেন। তিনি না থাকলে মেয়রের কাছাকাছি থাকা কর্মচারীরা সেই গাড়ি ব্যবহার করেন। তবে- পরিবহন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রকৌশলী রুহুল আলম খান জানিয়েছেন; ‘তৃতীয় গ্রেডের চাকুরে হওয়ার কারণে সোহেল গাড়ি পান না। সেটি মেয়রের নামেই বরাদ্দ।’
তিনি জানান, ‘জরুরি ভিজিটে মেয়র মাঝে মধ্যে ওই গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন বলে আমি জেনেছি।’ এদিকে- সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বেড়েছে। এতে করে নগর ভবনের ভেতরেও চলছে এক ধরনের অস্থিরতা। এ অস্থিরতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে রয়েছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তারা অনেক বিষয়ই পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। নগর ভবনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সোহেলর নানা কর্মকাণ্ডে তারাও অতিষ্ঠ। কিন্তু না পারছেন বলতে, না পারছেন সইতে। সব সময় মেয়রের দোহাই দিয়ে চলেন। মাঝে মধ্যে মেয়রকে দিয়ে প্রভাবও দেখান। গাড়ি বরাদ্দের বিষয়টি শীর্ষ কর্মকর্তারা ভালো চোখে নেননি। তবে সিটি করপোরেশনে প্রভাব খাটানো ও অনিয়মে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন চলতি দায়িত্বে থাকা মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব সোহেল আহমদ। তিনি জানিয়েছেন, ‘মেজরটিলার বাড়িটি তার নয়। সেই বাড়ির মালিক তার ভাই। তার নামে কোনো সম্পত্তি নেই বলে দাবি করেন তিনি