শুভ মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধধর্মালম্বীদের একটি তাৎপর্য দিন

 

 

সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

 

আগের কথা:-পারিলেয়(পা‌লি‌ল্যেয়) ছিল মূলত: এক‌টি পল্লীর নাম। এর প্বা‌র্শেই ছিল র‌ক্ষিত না‌মের এক অরণ্য। ভগবান বু‌দ্ধের দশম বর্ষাবাস  কে‌টে‌ছিল এ অর‌ণ্যেই। সে সময় এক হস্তীরাজ বর্ষাবাসকালীন সম‌য়ে ভগবান‌কে দিনরাত সেবা ক‌রেন।ঐ অর‌ণ্যের নিকটস্থ পল্লী‌তে ভগবানকে সেবাকারী হস্তীর নাম পা‌লিল্যেয় হস্তী। ভগবান কৌশম্বীর ভিক্ষু‌দের অ‌হেতুক কলহ বিবাদ দুঃখ থে‌কে দূ‌রে রাখার জন্য এই অর‌ণ্যে আগমন ক‌রেন এবং এক‌টি শাল বৃক্ষের নি‌চে অবস্থান ক‌রেন। অন্য‌দি‌কে ঐ হস্তীরাজও তাঁর হস্তীদ‌লে নানা অসু‌বিধা প্রত্যক্ষ ক‌রে নির্জনবা‌সের জন্য ঐ অর‌ণ্যে আগমন ক‌রেন। এভা‌বে বুদ্ধ এবং হস্তীরাজের পরষ্প‌রের সাক্ষাৎ হয়।

হস্তীরা‌জের সেবা-যত্ন :- বুদ্ধ‌কে দর্শ‌ণের পরই হস্তীরাজ বু‌দ্ধের প্র‌তি খুব প্রসন্ন হন। তি‌নি বুদ্ধ যে বৃ‌ক্ষের নী‌চে অবস্থান কর‌তেন সে বৃ‌ক্ষের আশেপা‌শে এক‌টি গা‌ছের ডাল দি‌য়ে প‌রিস্কার প‌রিচ্ছন্ন রাখ‌তেন। মুখ ধোবার জন্য এবং স্না‌নের জন্য নিত্য জল আ‌নয়ন কর‌তেন। দন্ত মার্জ‌নের জন্য ছোট উপযুক্ত ডাল তি‌নি বুদ্ধ‌কে দি‌তেন। ভগবান‌কে উপযুক্ত সম‌য়ের ম‌ধ্যেই তি‌নি নানা ফলমূল সংগ্রহ ক‌রে দান কর‌তেন। তি‌নি আগুন জ্বালা‌নোর জন্য উপযুক্ত কাঠও আনয়ন কর‌তেন। ক‌থিত আ‌ছে তি‌নি সে কাঠ এ‌কে অপ‌রের সা‌থে ঘর্ষণ ক‌রে আগুনও উৎপাদন কর‌তেন। সে আগু‌নে পাথর নি‌ক্ষেপ কর‌তেন। যখন পাথর গরম হত তি‌নি সেসব এক‌টি জলজমা স্নান উপযুক্ত উপত্যকায় ফেল‌তেন। এরূপ স্নান উপযুক্ত উষ্ণ জল প্রস্তুত হ‌লে তি‌নি ভগবানের পা‌শে গি‌য়ে অবস্থান কর‌তেন। ভগবানও তা বু‌ঝে স্নান ক‌রে আস‌তেন। এভা‌বে সে হস্তীরাজ খাবার জন্য সিদ্ধ জলও তৈ‌রি করতঃ বুদ্ধকে দান করতেন।হস্তীরাজের এ দান থে‌কে বুঝা যায় ভগবান হয়‌তো সিদ্ধজলই পান কর‌তেন।বুদ্ধ কখ‌নো গ্রা‌মে ভিক্ষা সংগ্র‌হের জন্য গে‌লে বু‌দ্ধের পাত্র চীবর পা‌লি‌ল্যেয় হস্তীই বহন করে বু‌দ্ধের নি‌র্দে‌শিত স্থা‌নে বুদ্ধ না ফিরা পর্যন্ত অবস্থান করতেন। বুদ্ধ ফি‌রে আস‌লে আবার পাত্র চীবর সংগ্রহ ক‌রে পুনঃ অর‌ণ্যে আসতেন। ভগবান ফি‌রে এসে আসন গ্রহণ কর‌লে তি‌নি গা‌ছের ডাল দি‌য়ে বুদ্ধ‌কে বাতাস কর‌তেন। রা‌ত্রি‌তে ভগবা‌নের বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ ইত্যা‌দির আক্রমণ থে‌কে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য এক‌টি উপযুক্ত দন্ড নি‌য়ে অর‌ণ্যে ভগবা‌নের আ‌শে পা‌শে ঘু‌রে বেড়া‌তেন।

বান‌রের মধু দান:-ঐ সময় এক বানর দীর্ঘ‌দিন ধ‌রে হস্তীরা‌জের সেবা পর্য‌বেক্ষণ ক‌রে বুদ্ধ‌কে নি‌জেও সেবা দান কর‌তে স‌চেষ্ট হ‌লেন। বানর‌টি এক‌টি মৌচাক এ‌নে বুদ্ধ‌কে দান কর‌লেন। কিন্তু বুদ্ধ তা গ্রহণ কর‌লেও খা‌চ্ছেন না দে‌খে বুুঝ‌তে পার‌লেন সেখা‌নে মধু‌পোকা ছিল। তি‌নি আবার বুদ্ধ থে‌কে সে মৌচাক নি‌য়ে চাক‌টি‌কে পোকা মুক্ত ক‌রে দান কর‌লেন। এবার ভগবানকে খে‌তে দে‌খে তি‌নি অ‌তি আন‌ন্দে লাফা‌তে লাগ‌লেন। এ দা‌নে তার এত প্রী‌তি উৎপন্ন হ‌য়েছিল যে খু‌শি‌তে তি‌নি এক গাছ থে‌কে আ‌রেক গা‌ছে লাফা‌ছি‌লেন কিন্তু হঠাৎ লাফা‌তে গি‌য়ে এক‌টি গাছ থে‌কে প‌রে মৃত্যু বরণ ক‌রেন এবং সা‌থে সা‌থে ‘মক্কট দেবতা’ না‌মে প‌রি‌চিত হ‌য়ে স্ব‌র্গে উৎপন্ন হ‌লেন। সহস্র সঙ্গী প‌রি‌বে‌ষ্টিত হ‌য়ে তি‌নি লাভ ক‌রেন তাব‌ত্রিংশ স্ব‌র্গে ত্রিশ যোজন উচ্চ এক স্বর্ণময় প্রাসাদ। মধু পূ‌র্নিমা মূলতঃ তাঁর কার‌ণেই সমাদৃত।।

পা‌লি‌ল্যেয় হস্তীর জ্ঞান:এ হস্তী‌টি সাধারণ হস্তী ছিল না। এ‌টি ছিল হস্তীরাজ। তাছাড়া এ‌টির বু‌দ্ধিমত্তা ও জ্ঞান প্রখর ছিল। যখন বর্ষাবাস শে‌ষে আনন্দ ভগবান‌কে আন‌তে যান তখন বুদ্ধ হস্তী‌কে জানান যে আনন্দ না‌মে যে ভিক্ষু‌টি আস‌ছে তি‌নি তাঁর শিষ্য। হস্তী তখন আনন্দ‌কে দেখ‌তে পে‌য়ে উনার কাছ থে‌কে চীবর ও পাত্র নি‌তে চাই‌লেন কিন্তু আনন্দ তা দি‌লেন না। ঐ সময় হস্তী ভে‌বে‌ছিল এই ভিক্ষু য‌দি স‌ত্যি ভগবা‌নের সেবক হন ত‌বে তি‌নি তাঁর পাত্র চীবর ভগবা‌নের পাত্র চীব‌রের পা‌শে রাখ‌বেন না। কারণ গুরুর বিষয়া‌দির পা‌শে শি‌ষ্যের বিষয় পাশাপা‌শি রাখ‌তে নেই! ভগবা‌নের পাত্র চীব‌র এক‌টি পাথ‌রের উপর ছিল কিন্তু আনন্দ নি‌জের পাত্র চীবর ভগবা‌নের পাত্র চীব‌রের নি‌চে মা‌টি‌তেই রাখ‌লেন। সে‌টি দে‌খে হস্তীরাজ তুষ্ট হন।

আনন্দ ৫০০শিষ্য নি‌য়ে সেখা‌নে গমন ক‌রে‌ছি‌লেন। ভগবান সেখা‌নে তাঁ‌দের দেশনা প্রদান ক‌রেন। ঐ ৫০০ শিষ্য সেখা‌নেই অরহৎ হন। পা‌লিলেয়্যক হস্তী তা‌দেঁরও নানা ফল মূল দান ক‌রেন। কিন্তু বুদ্ধ বর্ষাবাস শে‌ষে ফিরবার সময় হস্তীরাজ বুদ্ধ‌কে অর‌ণ্যে অবস্থা‌নের জন্য অনুনয় ক‌রেন। ভগবান তখন হস্তীরাজ‌কে ব‌লেন যে‌হেতু এ জীব‌নে সে ধ্যান, মার্গ কিংবা ফল কোনটাই লাভ কর‌তে পার‌বে না তাই তাঁর জন্য এতটুকুই পর্যাপ্ত। এই বলে ভগবান তা‌ঁকে মনুষ্য বস‌তি‌তে আস‌তে বারণ ক‌রেন। ফিরবার সময় যতটুকু দেখা যায় হস্তরাজ ততটুকু ভগবা‌নের পা‌নে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। প‌রে আর দেখতে না পে‌য়ে হৃদয় বিদীর্ণ হ‌য়ে মারা যান। তি‌নিও তা‌ব‌ত্রিংশ স্ব‌র্গে উৎপন্ন হন বলে উল্লেখ আছে । তাঁর জন্যও ত্রিশ যোজন উচ্চ প্রসাদ উৎপন্ন হয়। সহস্র সংগী প‌রি‌বে‌ষ্টিত হ‌য়ে তি‌নি সেখা‌নে ‘পা‌লি‌ল্যেয় দেবতা’ না‌মেই বর্তমা‌নে পরি‌চিত।

উল্লেখ আছে , অনাগ‌তে যে বুদ্ধগণ উৎপন্ন হ‌বেন সেই আর্য‌মিত্র, রাম, ধর্মরাজ প্রভৃ‌তির ন্যায় এই হস্তীরাজও বুদ্ধাংকুর।

কারণ- হস্তীরাজ ও বানর অতীত অতীত জন্ম থে‌কেই বু‌দ্ধের সা‌থে অবস্থান কর‌তেন। বিস জাত‌কে ৪৮৮নং দেখা যায় বুদ্ধ যখন ঋ‌ষি ছি‌লেন তখনও তারা যথাক্র‌মে হস্তী ও বানরই ছিল। সে জ‌ন্মেও তারা বো‌ধিসত্বের নিক‌টে অবস্থান কর‌তেন, শ্রদ্ধা বন্দনা‌দি কর‌তেন। বু‌দ্ধের অ‌ন্তিম জ‌ন্মেও তারা তাই বুদ্ধের সাক্ষাৎ পান।

তাই সারা পৃথিবীর মত  বিলাইছড়িতেও বৌদ্ধ  ধর্মালম্বীদের প্রায় ৫০টির ও বেশি  বৌদ্ধ বিহারে  বুদ্ধপূজা, মধুদান ও নানাবিধ দান,প্রার্থনা  ও পিণ্ডচরণ করা হয়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * বৌদ্ধধর্মালম্বী * মধু পূর্ণিমা * শুভ মধু পূর্ণিমা
লাইভ রেডিও
সর্বশেষ সংবাদ